‘বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখালেখির জন্যই আমাকে টার্গেট করা হয়’

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমানকে তুলে নিয়ে বহুল আলোচিত আয়নাঘরে আটকে রাখা হয়েছিল দুবার। প্রথমবার ২০১১ সালে ও দ্বিতীয়বার ২০১৮ সালে। তাকে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুতও করা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তুলে। আয়নাঘরে বন্দিত্বের কারণ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন 

আপনাকে আয়নাঘরে নেয়া হয়েছিল কেন? 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করার জন্য আমাকে টার্গেট করা হয়। বিডিআর ইস্যুতে আমি কথা বলতাম। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ইস্যুতে শেখ হাসিনা নিজে জড়িত। তার সঙ্গে থাকা লোকজনও দায়ী। বিডিআরের ঘটনার পর সেনাবাহিনীর ৯০-৯৫ শতাংশ লোক শেখ হাসিনা সরকারকে ঘৃণা করত। বাকি ৫ শতাংশ যারা তাকে চাইত, তারা হলো অসৎ জেনারেলরা। র‍্যাবে থাকার সময় আমাকে প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমি তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম। সেনাবাহিনীতে থাকাকালে ২০১১ সালে প্রথমবার আমাকে এসব কারণেই গুম করা হয়। 

প্রথমবার ক্যু করব বলে ধারণা থেকে গুম করে, যা মিথ্যা ছিল। সে সময় আমাকে ৪৩ দিন আটক রাখে। পরে সাবেক এক সেনাপ্রধানের সমালোচনা করে দেয়া এক নেতিবাচক পোস্ট শেয়ার করার শাস্তি হিসেবে আমাকে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর মিরপুর ডিওএইচএস থেকে আটক করা হয়। ওইদিন আমাকে যখন গুম করার জন্য আসে তখন আমার হাতে অস্ত্র ছিল। অনেকক্ষণ তাদের আমি নিয়ন্ত্রণ করে রাখি। কিন্তু একপর্যায়ে আমার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে। তখন আমার হাতে থাকা অস্ত্রটি দেয়ালের দিকে ছুড়ে ফেলে দিই। পরে পুলিশ আসে। সেই অস্ত্র উদ্ধার করে, সিজার লিস্ট হয়। আমার গুম হওয়ার মূল আলামত হলো পল্লবী থানার ওই সিজার লিস্ট। এর আগে ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আমাকে সেনাবাহিনী থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে চিঠি দেয়া হয়।

সেবার আমাকে তুলে নেয়ার পর প্রথম দিন আমাকে নির্যাতন করে প্রায় অজ্ঞান করে ফেলে। ওই বছর নির্বাচন হওয়ার পর ভেবেছিলাম আমাকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু দেখলাম ছাড়ার কোনো লক্ষণ নেই। ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আমাকে ছাড়া হয়। 

আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একপর্যায়ে আমার বিরুদ্ধে ১০টি মামলা করে। সে সময় প্রতিদিনই পুলিশের লোক এসে সন্ধান করত। ফলে দুই বছর কোনো ফোন ব্যবহার ছাড়া বাইরে বাইরে থাকতাম। তখন যারা আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছিল, অন্যরা কথা বলেনি। আমিই একমাত্র কথা বলতাম। বিজ্ঞানী ইকবাল চৌধুরী, মারুফ জামানরা গুমের শিকার হয়েছিল। 

আমার বিরুদ্ধে যখন অসংখ্য মামলা হয়ে গেল তখন আমি বাধ্য হয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান, আমেরিকান এম্বাসি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব জায়গায় আমি এ ঘটনা বর্ণনা করি। সে সময় সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজে এটি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। তখন প্রশ্ন আসে, এ লোকগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।

আয়নাঘর নিয়ন্ত্রণ কারা করেছে? 

কাকে ধরতে হবে, কাকে গুম করতে হবে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে শেখ হাসিনার তৎকালীন নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। বড় কিছু হলে শেখ হাসিনা নিজেই সিদ্ধান্ত নিতেন। আর ছোট ঘটনাগুলোর সিদ্ধান্ত নিত তারিক সিদ্দিক। আমি যেহেতু সেনাবাহিনীতে ছিলাম, তাই আমাকে গুম করার সিদ্ধান্তটি সরাসরি শেখ হাসিনা নিয়েছেন। 

শেখ হাসিনা সরাসরি সিদ্ধান্ত দেন আর তারিক আহমেদ সিদ্দিক সেটা বাস্তবায়ন করে। এছাড়া নিম্ন পর্যায় থেকে ডিজিএফআই ও র‍্যাব সিদ্ধান্ত নিত কাকে উঠিয়ে নিয়ে আসতে হবে, কাকে মারতে হবে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানই দেখত কারা বেশি কথা বলছে। আর মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান ও তারিক আহমেদ সিদ্দিক সেটি সমন্বয় করত। র‍্যাবের একজন সাবেক এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেলও (এডিজি) এখানে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ছিল। 

জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (এনটিএমসি) ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০১৮ সালের দিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ব্যবস্থা ক্রয় করে জেনারেল আজিজ। কিন্তু এটি মূলত ২০২০ সালে ব্যবহার শুরু হয়, যার মাধ্যমে কে কোথায় আছে, সেটি খুব সহজেই বের করা যেত। এছাড়া কে কী কথা বলছে। এনটিএমসি ছিল ডিজিএফআইয়ের অধীনে, যা দেখত মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান।

আমার গুমের ঘটনায় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিটিআইবি) তৎকালীন পরিচালকও জড়িত ছিলেন। ডিজিএফআইয়ে মেজর জেনারেল (অব.) সাইফুল আবেদীনসহ আরো কয়েকজন এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। 

আয়নাঘর নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাই। 

প্রথমে বুঝতে পারিনি কোথায় আছি। ওখানে ডিউটিরত প্রহরীরা মাঝে মাঝে অবজ্ঞা করে বলত, আপনি আয়নাঘরের মধ্যে আছেন, বোঝেন? পরে বুঝলাম এটি একটি সেল, যেখানে আলো প্রবেশ করে না। আয়নাঘর একটি রূপক নাম। এর মানে হলো আপনি একটি ঘরের মধ্যে থাকবেন, যেখানে আপনি শুধু আপনাকে দেখবেন আর কাউকে দেখবেন না। একটি আত্মপ্রবঞ্চনামূলক নাম। আয়নাঘরে কোনো ফ্যান নেই। যেখানে ২৪ ঘণ্টা হাই-পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে। পাশের রুমের কারো সঙ্গে কথা বলা যায় না। নতুন বিল্ডিংয়ের প্রতিটি রুমেই ক্যামেরা আছে। 

আয়নাঘরে ২৭টি বিশেষ কক্ষ ছিল। আমি লাল রঙের সাত-আটটি মোবাইল নম্বর লেখা দেখেছি। ওখানে কোনো কলম দেয়া হয় না। তাই হাতের আঙুল দাঁত দিয়ে কেটে সেই রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে ওই ফোন নম্বর। কোনোটা চিকন লেখা, কোনোটা মোটা। দেখলেই বোঝা যায়। রুমে ঢুকলেই ভয় লাগবে। 

রুমটি ছয় বাই নয় ফুট। ২৪ ঘণ্টাই অন্ধকার। সেলের ভেতর প্রচণ্ড গরম। শরীর থেকে প্রচুর ঘাম বের হতো। গরমের কারণে রাতে ঘুমানো যেত না। সেলে একটি খাটের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ছারপোকার কারণে খাটে ঘুমানোর সুযোগ ছিল না। ফ্লোরেই ঘুমাতাম। এদিকে বর্ষাকালে রুমগুলো ঘামানো থাকত। স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। খাটে বাজে মানের চাদর ব্যবহার করা হতো। সেই সঙ্গে পরার জন্য দিত ছেঁড়া গেঞ্জি আর অন্যের ব্যবহার করা পুরনো লুঙ্গি। বাথরুমে একটি ছোট তোয়ালে দেয়া হতো। যেটা পাঁচ বা তার অধিক মানুষের ব্যবহার করা। কোনো স্যান্ডেল দেয়া হতো না, ফলে খালি পায়ে হাঁটতে হতো। এসবের মধ্য দিয়ে আমাদের অবস্থা খারাপ করে দেয়া হয়। 

এছাড়া কম-বেশি প্রতিটি রুমেই সবাই আতঙ্কে-ভয়ে চিৎকার করে। পরিবার কেমন আছে, স্ত্রী কেমন আছে, বাচ্চারা কেমন আছে সেই আতঙ্ক। আমিও প্রথম দিন আতঙ্কিত ছিলাম। চিৎকার শুনছিলাম। আমিও ভাবছিলাম না জানি আমার স্ত্রী কিংবা মেয়েকে নিয়ে এসেছে কিনা। তারা যেকোনো কিছু করতে পারত। তাদের কাছে নীতিনৈতিকতা বলে কিছু ছিল না। এমনও হয়েছে যে আজকে এক রুমে একজন এসেছে, যেখানে গতকাল কেউ ছিল না। হয়তো আজকে আলো জ্বলছে। প্যানিকড হয়ে পড়তাম। 

রাতে কাউকে টর্চার করে নিয়ে আসত। শোনা যেত সে চিৎকার দিতে দিতে রুমে আসছে। পাশে ইন্টারোগেশন সেল। সেখানে চিৎকার হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছি। এ চিৎকারের মধ্যে কেউ তো ঘুমাতে পারে না। এর মধ্যে ভয় দেখানোর জন্য মাঝরাতে তারা বারান্দা দিয়ে হাঁটা-চলাফেরা করত, ধমক দিত। 

দিনে গোসলসহ অন্যান্য প্রয়োজনে চারবেলা বাথরুমে নিয়ে যেত। চোখ বেঁধে, হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে সেল থেকে বের করে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হতো। বাথরুম থেকে এনে সেলে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মারা হতো। সেলের সামনে লোহার গেট, তারপর কাঠ। কাঠের মধ্যে একটি ছিদ্র করা। এ ছিদ্র দিয়ে সেলে কে কী করত, তা পর্যবেক্ষণ করা হতো। 

প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার নাপিত আর ঘর মোছার লোক আসত। সেনাবাহিনীতে ঘর মোছার লোককে এনসি বলে। আমার এখানে যারা আসত, তাদের এনসি বলে ডাক দিলে রেসপন্স করত। তখনই বুঝতে পারি তারা সেনাবাহিনীর লোক। 

প্রতিদিন সকালে দরজায় কড়া নাড়ত ডাকার জন্য। এমনও হয়েছে যাকে ডেকে নিয়ে গেছে সে ব্যক্তি আর ফেরেনি। ফলে সবসময়ই আতঙ্কে থাকতাম যে একেবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসছে কিনা, এবার নিয়ে মেরে ফেলবে কিনা? 

আয়নাঘরে থাকাকালীন শারীরিক কী ধরনের সমস্যা হয়েছে?

ওখানে থাকাকালে একবার স্ট্রোক করি। সে সময় তারা বলে, কোনো সমস্যা নেই; ঠিক হয়ে যাবে। কোনো চিকিৎসা হয়নি। প্রথম কয়েক দিন দেখে, পরে আবার সাধারণ নিয়মে প্রেসারের ওষুধ চলেছে। ওখানে প্রচুর মশা। আমার পুরো শরীরে মশার কামড়ের চিহ্ন, দুই বছর পরও সেই দাগ রয়ে গেছে। এতটা বাজে অবস্থা ছিল। 

ওখানে আমাদের ওষুধ দিত প্যাকেট খুলে। কোনো ওষুধই প্যাকেটসহ দেয়নি। ওষুধের প্যাকেটের গায়ে সেনাবাহিনীর সিল মারা থাকত বিধায় তারা প্যাকেটসহ ওষুধ দিত না। ফলে ভুলে মাঝে মধ্যে একজনের ওষুধ আরেকজনকে দিয়ে দিত। 

একইভাবে ধর্মীয় বই বা কবিতার বই চেয়েছিলাম, দিয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও তারা ওই লেখা মুছে দেয়ার চেষ্টা করেছে। তার পরও আলোর নিচে ধরলে সেটি বোঝা যেত। ডিজিএফআইয়ে নিজস্ব প্রশাসনের জন্য দুজন ডাক্তার আছে। তারাই আয়নাঘরের রোগীদের দেখতে আসত। 

খাবারের ব্যবস্থা কেমন ছিল?

রুমের নিচ দিয়ে খাবার দেয়া হতো। দিনে দুবার খাবার দেয়া হতো। সপ্তাহে ১৪ বার। এর মধ্যে চারবেলা তিন টুকরা করে গরুর মাংস, চারবেলা ফার্মের মুরগি, চারবেলা নিম্ন মানের মাছ আর দুইবেলা ডিম। সকালবেলা নাশতা দেয়া হয়। শুক্রবারের নাশতাটা ভিন্ন থাকে। বুটের ডাল আর রুটি। রুটি বলতে সেনাবাহিনীর পুরির মতো রুটি। এ তথ্যগুলো নিয়ে ২০২২ সালে যখন আয়নাঘর-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হলো, তখন অনেক কিছুতে পরিবর্তন আনা হয়। যাতে এসব বিষয়ে সাযুজ্য না থাকে। শুরুতে কেউ যদি বুটের ডাল আর সেমাই পেয়ে থাকে, তবে তাকে বুঝতে হবে সে আয়নাঘরের ভেতরে ছিল। 

ওখানে প্রহরীরা ছিল ভাড়াটে। বেসামরিক লোক। আমাদের ১০ রুমের জন্য দুজন প্রহরী। আর অফিসারদের ১৭ রুমের জন্য দুজন। দুজন থাকত মনিটরের জন্য। আর একজন ছিল ভেতরে রান্নার জন্য। সব মিলিয়ে আট-নয়জন হতে পারে। তাদের দুই শিফটে ডিউটি ছিল। ৪ ঘণ্টা ডিউটি করে ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম নিত। 

আয়নাঘরের শুরু কবে?

পাকিস্তান আমলে কচুক্ষেতের এই পুরনো বিল্ডিংয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি রুম ছিল, যা ছিল জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি)। প্রতিবেশী দেশের গুপ্তচর বা সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এখানে আনা হতো। ষড়যন্ত্রমূলক কিছু হলে তিন বাহিনীর লোকেরা মিলে জিজ্ঞাসাবাদ করত। 

পুরনো বিল্ডিংয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি রুম আছে। এটি এসি রুম। কিন্তু এখানে টর্চারের জন্য আলাদা একটি রুম আছে। যেখানে ঘোরানো-ঝোলানোর ব্যবস্থা আছে। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে পুরনো বিল্ডিংগুলো দেখতাম। এখানে নামাজ পড়তাম। রুমগুলো তালাবদ্ধ থাকত। পরিত্যক্ত, ব্যবহার হতো না।

স্বাধীনতার পর খুবই কম ব্যবহার করা হতো। মূলত এক-এগারোর সময় পাকিস্তান আমলে তৈরি করা এসব কক্ষ ব্যবহার করা হতো। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও শেখ সেলিমকে এখানে আনা হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে রাগ করতাম। তখন বলত, এখানে তারেক সাহেব ঘুমিয়েছে, আপনার এত সমস্যা? 

এক-এগারোর সময় মইন ইউ আহমেদ এটির অপব্যবহার করে। এখানে রাখার পর ওবায়দুল কাদের ও শেখ সেলিমরা বিভিন্ন কথা স্বীকার করেছিল। তখন নির্যাতন করা হয়নি। এখানে নিয়ে আসার পরপর টর্চারের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আমরা শুনেছি তারেক রহমানকে ঝোলানো হয়েছিল।

পরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এটিকে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগানো শুরু করে। ২০০৯ সালে আরো একটি নতুন বিল্ডিং তৈরি করা হয়। যেখানে ১০টি সেল করা হয়। ২০২২ সালে আমি মুক্তি পাওয়ার পর এটিকে আরো একতলা বাড়ানো হয়। যেখানে ১০টি রুম বাড়ানো হয় বলে জানতে পারি। 

ওই রুমগুলো মসৃণ। ১৮ ফুট লম্বা। কোনো ফ্যান নেই, কিন্তু ঠাণ্ডা। দৈর্ঘ্যে ছিল সাড়ে নয় ফুট। রুমের সামনে বারান্দা ছিল ছয় ফুটের। বারান্দায় এগজস্ট ফ্যানের ব্যবস্থা ছিল। এখানে এত জোরে শব্দ করত মনে হবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া। মনে হবে এখানে কাজ হচ্ছে। কেউ চিৎকার দিলেও যাতে বাইরে শোনা না যায়। এখানে আরো ১৭টি রুম ছিল, যেখানে বন্দিদের রাখার ব্যবস্থা আছে। ওই রুমগুলোয় কষ্ট তুলনামূলক কম। ২০২০ সালের পর ওপরে আরেকটি ফ্লোর নির্মাণ করা হয়, যেখানে ১০টি রুম বাড়ানো হয়। 

টর্চারের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে?

প্রথমে শক্তভাবে চোখ বাঁধে যাতে কোনোভাবে দেখতে না পারে। তারপর টর্চার সেলে নিয়ে যাবে। টর্চার রুমে নেয়ার পরই হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলত। এরপর যাকে যেভাবে নির্যাতন করার দরকার সেভাবে করত। কারো নখ উপড়ে ফেলত। কাউকে ঝোলানো হতো। লোমহর্ষক ব্যাপার। কেউ যখন কান্নাকাটি করতে করতে রুমে আসত, তখন বুঝতাম যে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রায় ৩০ জন লোককে মাসে একবার এভাবে নির্যাতন করা হতো। প্রতিদিনই এ রকম কান্নাকাটি শোনা যেত। ওই আতঙ্কে বাকিরা ঘুমাতে গেলেও ঘুমাতে পারত না।

এখানকার বন্দিদের মধ্যে বৃদ্ধ লোকও ছিল। হয়তো অসৎ উদ্দেশ্যে টাকা আদায়ের জন্য এখানে আনা হয়েছে। হয়তো সরকারপ্রধানরা এসব বিষয়ে জানেও না। আমি গুম হওয়ার পর আমার মেয়ের কাছ থেকেও ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিল। 

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর স্যাংশন আসার পর কোনো পরিবর্তন দেখেছেন?

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মন্ত্রীর মেয়ের জামাই বিচারের মুখোমুখি হওয়ায় এর প্রভাব পড়তে দেখা যায়। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর স্যাংশন আসায় গুম বন্ধ হয়ে যায়। স্যাংশনের পর অধস্তন কর্মকর্তারা এ ধরনের কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করে। পাশাপাশি তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন