মিয়ানমার প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান

এক বন্ধুকে খুশি করতে গিয়ে আমরা অন্যের বিরাগভাজন হতে পারি না

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

সেনাবাহিনী প্রধান এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘মিয়ানমারের কিছু সামরিক নেতার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিজেদের সমস্যায় ফেলার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ সবাই আমাদের বন্ধু। এক বন্ধুকে খুশি করতে গিয়ে আমরা অন্যের বিরাগভাজন হতে পারি না। এ বাস্তবতা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। আমি নিশ্চিত করতে চাই যে আমরা আমাদের সেরাটা করছি এবং আমরা সঠিক পথে আছি।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে গতকাল ‘‌ডিফেন্স ডিপ্লোম্যাসি: স্ট্র্যাটেজি ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরির বিষয়ে পরামর্শ এসেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথা বলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ।

গতকাল অনুষ্ঠিত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিআইআইএসএসের চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত এএফএম গওসোল আযম সরকার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিআইআইএসএসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আবু বকর সিদ্দিক খান। সেমিনারে আরো উপস্থিত ছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

সেমিনারে চারটি বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। ‘‌ইভলভিং নোশন অব ডিফেন্স ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড ইটস রোল ইন অ্যাচিভিং ফরেন পলিসি গোলস’ শীর্ষক উপস্থাপনা পেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম আলী আশরাফ। ‘‌গ্রোয়িং জিওপলিটিক্যাল কম্পিটিশন: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড অপরচুনিটিজ অব ডিফেন্স ডিপ্লোম্যাসি ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক উপস্থাপনা পেশ করেন বিআইআইএসএসের রিসার্চ ফেলো এএসএম তারেক হাসান শিমুল। ‘‌ডিফেন্স ডিপ্লোম্যাসি ইন ইউনাইটেড ন্যাশনস অ্যান্ড আদার ওভারসিজ মিশনস: হরাইজন টু এক্সপ্লোর’ শীর্ষক উপস্থাপনা পেশ করেন মেজর জেনারেল (অব.) মাইন উল্লাহ চৌধুরী। ‘‌এক্সিসটিং প্র্যাকটিসেস অব ডিফেন্স ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড ফিউচার ডিরেকশনস: দ্য কেস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক উপস্থাপনা পেশ করেন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন। এসব উপস্থাপনায় নানা বিষয়ে পরামর্শ দেন বক্তারা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান। তিনি বলেন, ‘অভিপ্রায় হঠাৎ করে বদলে যেতে পারে। কিন্তু সক্ষমতা হঠাৎ করে বদলায় না। আজ একজন বন্ধু আছে। কিন্তু কাল সে বন্ধু নাও থাকতে পারে। জাতীয় স্বার্থ ও মাতৃভূমি সুরক্ষার জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়” এবং সামরিক বাহিনী পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সবকিছু করছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর মূল কাজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং আমরা এটি কখনো ভুলি না। আমরা সবসময় এর জন্য তৈরি।’

জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের স্বার্থ ও কৌশলের জন্য সামরিক কৌশল দরকার এবং এটির মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের অবস্থান ঠিক করি। বিচ্ছিন্নভাবে এটি অর্জন করার সুযোগ নেই। মাঝে মধ্যে আমাদের তাই ভাবনা আসে, কে নেতৃত্ব দেবে বা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার হাতে থাকবে। এটি কখনো কখনো সমস্যা তৈরি করে।’

সরকারি কাজ সমন্বয়ের জন্য একটি সংস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, ‘অনেক বিষয় আছে, যেটি আমরা শুরু করেছিলাম। কিন্তু শেষ করতে পারিনি। কারণ পরবর্তী সময়ে সেটি আমাদের হাতে থাকেনি। যখনই আমি ব্যবসা খাতের জন্য একটি সম্ভাবনা খুঁজে বের করলাম, সেটি পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে চলে যায়। কাজেই এখানে যে প্রস্তাব এসেছে, সেটি আমি সমর্থন করি এবং মনে করি, একটি সংস্থা দরকার, যেটি সমন্বিত উদ্যোগ নিশ্চিত করবে, যার মাধ্যমে যেটি অর্জন করা হয়েছে, সেটি হারিয়ে যাবে না এবং এর ভবিষ্যৎ কার্যক্রম ঠিক করবে।’

চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার উজ্জামান বলেন, ‘অনেকের হয়তো প্রতিরক্ষা কূটনীতি নিয়ে ভুল ধারণা আছে। কিন্তু আমাদের কূটনীতিকরা এর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি খুব ভালোমতো বোঝেন।’

বিআইআইএসএসের চেয়ারম্যান এফএম গওসোল আজম সরকার বলেন, ‘‌বৃহৎ পররাষ্ট্রনীতির পরিসরে প্রতিরক্ষা কূটনীতি কাজ করে।’

প্রবন্ধ উপস্থাপক ও আলোচকরা বলেন, একটি দেশের বৈদেশিক ও নিরাপত্তানীতির উদ্দেশ্য পূরণে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিরক্ষা কূটনীতি একটি কার্যকর হাতিয়ার এবং সংকট প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিরক্ষা কূটনীতিকে বিশ্বশান্তি রক্ষার্থে সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহার, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটা দেশের জাতীয় স্বার্থ ও পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।

তারা আরো বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ প্রতিরক্ষা কূটনীতির একটি দৃষ্টান্ত, যা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শনের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী এর গুরুত্ব ও প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক অঙ্গনে প্রতিরক্ষা কূটনীতির ধারণা ও আবেদন বিস্তৃত হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা, বিদেশী দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি, ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, সাবেক কূটনীতিক, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা অংশ নেন। তারা মুক্ত আলোচনায় তাদের মতামত ও পরামর্শ দেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন