টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি

জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলো নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

ছবি : বণিক বার্তা

দীর্ঘ সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার বিরাজ করছে। এ হার ৯ শতাংশের ওপরে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের পাঁচ লাখের মতো মানুষকে চরম দারিদ্র্যের স্তরে ঠেলে দিয়েছে মর্মে বিশ্বব্যাংকের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর আগে তারা দারিদ্র্য স্তরে অবস্থান করছিল বলে ধারণা করা হয়। টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে দেশের নিম্ন মধ্যবিত্তের অনেকের দারিদ্র্য স্তরে নেমে যাওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। এর আগে নভেল করোনাভাইরাস তথা কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবকালে এমনটা ঘটেছিল। টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলো কীভাবে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে যাচ্ছে এবং তা কীভাবে সামাজিক স্তর বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটাতে পারে—এসব আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। 

২৭ মার্চ বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরের পুরো সময়ে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেও এ ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় থাকতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে টানা ২০ মাস দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের জীবনযাপনও কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনীতিতে তিন দশকে আর কখনই এত দীর্ঘসময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্থায়ী হতে দেখা যায়নি। এদিকে ৪ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে পাঁচ লাখের মতো মানুষ চরম দারিদ্র্যের স্তরে নেমে এসেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ভোগক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে দারিদ্র্য হ্রাস প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্যে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দরিদ্র খানাগুলো, যাদের বাজেটের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় খাদ্যপণ্য ক্রয়ে। সরকারের পরিকল্পনা দলিলে দারিদ্র্যকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি দারিদ্র্য, অন্যটি চরম দারিদ্র্য। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫) অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যু্রোর (বিবিএস) ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ (এইচআইইএস) অনুযায়ী, জাতীয় দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আর চরম দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ‘মডারেট পভার্টি’ অর্থাৎ ‘মাঝারি দারিদ্র্য’ নামে আরেকটি স্তরের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, মাঝারি দারিদ্র্যের হার এক বছর আগের ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। 

আমাদের সংবিধানে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোর উল্লেখ করতে গিয়ে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে [অনুচ্ছেদ ১৫ (ক)]। আবার মানুষের জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোর শীর্ষে অবস্থান অন্ন তথা খাদ্যের। গত বছর (২০২৩) দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির গড় ১০ শতাংশের নিচে নামেনি; আর অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা প্রায় ১২ বছরে সর্বোচ্চ। খাদ্যের বেশ কয়েকটি উপাদান থাকলেও দেশে খাদ্য বলতে সাধারণত শর্করাজাতীয় খাদ্য ভাতকে বোঝায়, যা দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য। ভাত আমাদের ক্যালরির প্রধান উৎস। গত কয়েক বছরে চালের দামে উল্লম্ফন ঘটেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বরাত দিয়ে ১ এপ্রিল একটি দৈনিকের (প্রথম আলো) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর বাজারে এখন প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। মাঝারি চাল ৫৫-৫৮ ও সরু চাল ৬৫-৭৬ টাকায় কিনছেন ক্রেতারা। ২০২০ সালের শুরুতে মোটা চালের সর্বনিম্ন দর ছিল প্রতি কেজি ৩০ টাকা। সরু চাল পাওয়া যেত প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ৪৫ টাকায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট খরচের ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ হয় খাদ্যে। আবার মাসিক মোট ব্যয়ের ৩৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কেনায়। চালের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব নিম্নবিত্তের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়লেও নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চালের মূল্যস্ফীতিতে তাদের মাছ, মাংস, ডিমসহ আমিষজাতীয় খাবার কেনা কমিয়ে দিতে হচ্ছে। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের পুষ্টির অভাব ঘটছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিড) সম্প্রতি জানিয়েছে, পণ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে দেশের ১২ কোটি ৫২ লাখ মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। এমনিতেই দেশের জনগণের পুষ্টিমান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অনেক নিচে। এতে অবস্থার আরো অবনতি ঘটবে।

আমাদের দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গম। পণ্যটির চাহিদার (বার্ষিক ৭০-৭৫ লাখ টন) প্রায় ৮৫ শতাংশ মেটাতে হয় আমদানির মাধ্যমে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা টাকার মূল্যমান হ্রাস অবমূল্যায়ন, ডলার সংকটের কারণে পণ্যটির আমদানি হ্রাস ইত্যাদি কারণে পণ্যটির দামে উল্লম্ফন ঘটেছে। টিসিবির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের মার্চে প্রতি কেজি খোলা আটা ৩৫-৩৬ টাকা, প্যাকেট আটা ৪০-৪৫, খোলা ময়দা ৪৭-৫০ ও প্যাকেট ময়দা ৫২-৫৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা ৫০, প্যাকেট আটা ৬০-৬৫, খোলা ময়দা ৬৫-৭০ ও প্যাকেট ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকে আটা ও ময়দা খাওয়া ছেড়ে দিয়ে চালের দিকে ঝুঁকছেন। এতে বেড়ে যাচ্ছে চালের চাহিদা। 

বেড়েছে আমিষজাতীয় খাদ্য মাছ, মাংস, ডিম, ডালের দাম। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২১ সালে কেজিপ্রতি ৬০০ টাকায় বিক্রি হওয়া গরুর মাংস বর্তমানে রাজধানীতে বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৭৮০ টাকায়। ২০২৩ সালের শুরুতে কেজিপ্রতি ৭৫০-৭৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া খাসির মাংস এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ টাকায়। ২০২১-২৩ সময়ে বাজারে গড়ে সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে ৩৫-৪০ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে মুরগির ডিমের হালির গড় দাম ছিল ২৭ টাকার আশপাশে। এখন তা ৫৫ টাকায় উঠেছে। বেড়েছে গরিবের আমিষ হিসেবে পরিচিত ডালের দাম। এক বছর আগে প্রতি কেজি ১১০ টাকায় বিক্রি হওয়া মসুর ডাল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। এক বছর আগে প্রতি কেজি ৯৫-১৩৫ টাকায় বিক্রি হওয়া মুগডাল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমিষজাতীয় এসব খাদ্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। 

বেড়েছে মসলার দাম। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, দারুচিনি, জিরা, এলাচি, লবঙ্গ, ধনিয়া, তেজপাতা ও শুকনা মরিচের দাম গত এক বছরে সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১২৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত বছর রমজানে ২৫-৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ এবার বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। গত বছর ১৫০-১৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া আদা এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫০-২৮০ টাকায়। 

জীবনধারণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো স্বাস্থ্যসেবা। ২০১৯ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সূচকে বৈশ্বিক গড় মানের (স্কোর ৪২ দশমিক ২) চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা ছিল খারাপ। ৩৫ স্কোর নিয়ে ১৯৫টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৩। গত ৫ ফেব্রুয়ারি একটি দৈনিকে (যুগান্তর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জন, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সূচক ও স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক সূচকে অনেক পিছিয়ে আছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জনের সার্ভিস কাভারেজ সূচকে ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান স্কোর ৫২, যা ২০৩০ সাল নাগাদ কমপক্ষে ৮০-তে উন্নীত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের বরাত দিয়ে ৫ এপ্রিল বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত খাতগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি ছিল স্বাস্থ্যসেবায়। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মোট ব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বর্তমানে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ। তথ্য বলছে, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ সরকারের মাথাপিছু ব্যয় প্রতিবেশী সব দেশের তুলনায় কম।

জীবনধারণের একটি মৌলিক উপকরণ হলো শিক্ষা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত বেসরকারি খাতভিত্তিক হওয়ায় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি, পরীক্ষা ফি ইত্যাদির পরিমাণ অনেক বেশি বিধায় ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষা ব্যয় বেড়েই চলেছে। তাছাড়া নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শ্রেণী শিক্ষার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় শহর ও গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট ও কোচিংয়ের দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকছে। প্রাইভেট কোচিংয়ের ব্যয় মেটাতে অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছেন। ২০২৩ সাল ইউনেস্কো প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের ফাইন্ডিংস অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে মোট খরচের ৭১ শতাংশের জোগান আসে পরিবারগুলো থেকে, যা শিক্ষা খাতে পরিবারপিছু খরচের বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ হার। শিক্ষা খাতে খরচ মেটাতে এসব পরিবার সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে পারছে না।

বাসস্থান মানুষের আরেকটি মৌলিক চাহিদা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম ও শহরাঞ্চলে বাসস্থানের চাহিদা দিনদিন বেড়েই চলেছে। অপরিকল্পিতভাবে বাসস্থান নির্মাণের জন্য গ্রামাঞ্চলে নষ্ট হচ্ছে প্রচুর পরিমাণ মূল্যবান কৃষিজমি। বর্তমান সরকার গ্রামাঞ্চলে পরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণ কর্মসূচি গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে কর্মসংস্থান, উন্নতমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য শহরমুখী মানুষের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার আগেই দেশে জমি ও নির্মাণসামগ্রীর ব্যয় বাড়তে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি কারণে জমি, নির্মাণসামগ্রীর দাম হুহু করে বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি নির্মাণ ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। তাছাড়া শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও অন্যসব মহানগরীতে হোল্ডিং কর বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বহুলাংশে বেড়েছে। এসব কারণে বাড়ি ভাড়া বেড়েই চলেছে। রাজধানী ঢাকায় ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ ভাড়া বাড়িতে বাস করে এবং তাদের আয়ের একটি বড় অংশ বাড়ি ভাড়ায় ব্যয় হয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় অর্ধেক, ১২ শতাংশ আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাড়ি ভাড়া খাতে। ফলে বাড়ি ভাড়া মেটানোর পর ভাড়াটিয়াদের সংসার নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

তাছাড়া জীবনধারণের অন্যান্য উপকরণ, যেমন যাতায়াত, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, বিনোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। প্রাপ্ত তথ্যে বলছে, গত বছর তিন দফায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৫ শতাংশ। চলতি বছরে এরই মধ্যে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৮ শতাংশ। রাজধানীতে ঢাকা ওয়াসা বাড়িয়েছে পানির দাম। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৪ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির তুলনায় একদিকে যেমন মানুষের আয় বাড়েনি, অন্যদিকে যেটুকু আয় বেড়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন তা গিলে ফেলেছে। এতে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ফলে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে পাঁচ লাখের মতো মানুষ চরম দারিদ্র্যের স্তরে নেমে এসেছে। এর আগে তাদের অবস্থান ছিল দারিদ্র্য স্তরে। একই কারণে নিম্নবিত্তের অনেকের দারিদ্র্য স্তরে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়ে এমনটা ঘটেছিল। ২০২৩ সালের মে মাসে রাজধানীতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সম্মেলনে জানানো হয়, করোনার কারণে ঢাকায় নতুন দরিদ্রের আবির্ভাব ঘটে। গত বছর ঢাকায় মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই ছিল নতুন দরিদ্র, যারা নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে আসে। এর অর্থ দাঁড়ায়, চলমান টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেমন একদিকে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে সামাজিক স্তরবিন্যাসে পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন