প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের ঘরে নেমেছে

অর্থনীতির দুর্বল গতির প্রতিফলন

ছবি : বণিক বার্তা

বর্তমানে দেশের অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা বিগত তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ পরিস্থিতির মধ্যে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। কৃষি খাতে সামান্য প্রবৃদ্ধি ঘটলেও আশঙ্কাজনক হারে কমেছে শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পের কাঁচামালের দাম যৌক্তিক সীমায় নেমে এলেও এর সুবিধা নিতে পারেনি দেশের শিল্প-কারখানাগুলো। জ্বালানি সংকট ও আমদানি সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্প তার সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। ডলারের উচ্চমূল্যে বেড়ে গেছে উৎপাদন ব্যয়। এমন নানা সংকটের মুখে শিল্পের প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমে এসেছে। যে শিল্পের ওপর ভর করে দেশের জিডিপি এগিয়ে যাচ্ছিল, তা এখন নিম্নমুখী। জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জ্বালানি সংকট নিরসন ও আমদানি বাড়িয়ে শিল্প-কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নিতে হবে।

দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে সেবা খাত। এর পরই শিল্প খাতের অবস্থান। গত কয়েক অর্থবছরে অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল ৩৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। জিডিপিতে এক-তৃতীয়াংশের বেশি অবদান রাখা খাতটির প্রবৃদ্ধি এখন মারাত্মক হারে হ্রাস পাওয়ায় কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। 

বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুসারে, বিবিএসের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত দুই অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে কম। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এবার তা কমে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমেছে। শিল্প খাতের এ ধাক্কার মূল কারণ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা—বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বড় ঘাটতি ইত্যাদি। সবকিছুর ফলে দেশের উৎপাদন খাত ব্যাহত হয়েছে। শিল্প খাতে বড় দুটির একটি উৎপাদন খাত। এটি ব্যাহত হয়েছে আমদানি সীমাবদ্ধতার কারণে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট আগেও ছিল। এখনো বিদ্যমান। একই সঙ্গে রফতানিও কম হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের শিল্প খাতে প্রভাব পড়েছে। শিল্প খাতের আরেকটি বড় অংশ জ্বালানি খাত। এ খাতও ব্যাহত হয়েছে, কারণ আর্থিক সংকটের কারণে যথাসময়ে গ্যাস আমদানি করা যায়নি। যার কারণে বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খাতের ধীরগতির কারণেই দেশের প্রবৃদ্ধি কমেছে।

উৎপাদন খাতের প্রাণ হলো দেশের ছোট-বড় কলকারখানা। এসব কলকারখানার মূল জ্বালানি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস। তবে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন খাত এরই মধ্যে নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ, যেটি আগের প্রান্তিকেও ছিল ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ছিল ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আঘাত হানতে পারে। টাকার প্রবাহ কমানোর ফলে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ঠিকমতো ঋণ পাচ্ছেন না। তারা নতুন বিনিয়োগে যেতে পারছেন না। এতে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমদানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেও (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে তা ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়েছিল। অর্থনীতির স্থবিরতার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার বাড়ানোর কথা ভাবছে। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে এলসি খোলার হার ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এরই মধ্যে দুর্বল কৌশলের নেতিবাচক প্রভাব জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে পড়তে শুরু করেছে। মানুষের কাজের সুযোগ কমছে। বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ২৩ লাখেরও বেশি মানুষ বেকার। 

অর্থনীতির গতি ধীর হওয়ায় বিনিয়োগের গতিও কম। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ ৩৬ শতাংশ কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট এফডিআই এসেছে ৯১৩ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া নিট বিনিয়োগ ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার থেকে ৬৭০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে সময়োপযোগী ও বিনিয়োগবান্ধব মুদ্রানীতি প্রয়োজন। 

বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক সব সংকট থেকে মুক্তি পাচ্ছে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক মুক্তির পথ খুঁজছে! দেশে নতুন ‘স্থিতিশীল সরকার’ এসেছে, এখন অর্থনীতিতে চাহিদা পূরণের সময়। অথচ উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না। কারণ মোট আমদানির ৭৫ শতাংশই শিল্পের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও মধ্যবর্তী পণ্য। অথচ সুদের হার বাড়ানো হলো প্রবৃদ্ধিকে আটকে দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। জোর করে ডলারের দর ধরে রেখে হুন্ডিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সংকটটা এখন প্রাথমিক থাকলেও তা কিছুদিন পর আরো কঠোর হবে। 

দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আয়ে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুসারে, বর্তমানে রাজস্ব ঘাটতি ২৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। 

আমদানি কমায় ব্যাংকের লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) কমিশন থেকে রাজস্ব আয় কমে গেছে। অথচ লক্ষ্যমাত্রা ধরার সময় রাজস্বের বড় উৎসই মনে করা হয়েছিল এলসি কমিশনকে। এলসি কমিশন কমে যাওয়ার অর্থ ব্যাংকেরও ব্যবসা কমে যাওয়া। ব্যাংকের আয় কমলে রাজস্ব কমে যায়। আর রাজস্ব কমলে সরকারের ব্যয় কাটছাঁট করতে হয় অথবা দেনা করতে হয়। 

রাজস্ব আয় কমার ফলে সরকারের দেনা বাড়ছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না ঠিকমতো। পরিকল্পনা কমিশনের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ইতিহাসের সবচেয়ে কম বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে। এ সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর আগের কোনো অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। সামনে এডিপির বড় একটি অংক কাটছাঁট করতে হবে। আর এসবই জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার উপসর্গ।

এদিকে অন্য বছরের সঙ্গে এবারের জিডিপির এত পার্থক্য থাকার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সংস্থাটি বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কোয়ার্টারলি ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস ম্যানুয়াল অনুসারে, কোনো প্রান্তিকের জিডিপির প্রথম প্রাক্কলনের সময় হালনাগাদ সব তথ্য-উপাত্ত বিদ্যমান থাকে না বিধায় পরবর্তী সময়ে তা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। ফলে পূর্ববর্তী প্রান্তিকের প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ শীর্ষক ষাণ্মাসিক প্রতিবেদনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমার আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ থাকলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। এতে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। আগের অর্থবছরেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একই ছিল। 

জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে, খুচরা বাজার ও আনুষ্ঠানিক বাজারে ডলারে বিনিময় হারের বেশি ব্যবধান রাখা যাবে না। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা দরকার। যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি করে শিল্প খাতের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট সমাধানে গুরুত্ব দিতে হবে। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে আশু পদক্ষেপ কাম্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন