বিশ্লেষণ

জাপানের সঙ্গে ইপিএ চুক্তিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুযোগ

ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম

ছবি : বণিক বার্তা

অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি বা ইপিএ হলো বিভিন্ন দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য এলাকা বা এফটিএ তৈরির পরিকল্পনা। অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বিষয়টি বোঝার আগে আমাদের মুক্ত বাণিজ্য বিষয়টি বুঝতে হবে। কারণ দেশের বেশির ভাগ মানুষই এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। গ্লোবাল ভিলেজের এ যুগে কোনো একটি দেশের জনগণ অগ্রগতির সঙ্গে তাল না মেলালে স্বাভাবিকভাবেই দেশ পিছিয়ে পড়বে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই এসব বিষয়ে উদাসীন। বৈদেশিক নানা চুক্তির মাধ্যমে দেশের লাভ-ক্ষতির বিষয়টি না বুঝলে দেশের উন্নয়ন এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জমা-খরচের হিসাবও কখনো মেলাতে পারবেন না তারা। 

আশার কথা হলো, ‘মুক্ত বাণিজ্য’ বিষয়ে আমাদের দেশের আমদানি-রফতানি ব্যবসায় জড়িতরা ভালো ধারণা রাখেন। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে (এফটিএ) স্বাক্ষর করা সদস্যদেশগুলোর একটি বাণিজ্য ব্লকে অন্তর্ভুক্তকৃত এলাকা হলো মুক্ত বাণিজ্য এলাকা। বাণিজ্যে বাধা, আমদানি কোটা, শুল্ক কমাতে এবং একে অন্যের সঙ্গে পণ্য ও পরিষেবার বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য এ ধরনের চুক্তিগুলোর মধ্যে অন্তত দুটি দেশের মধ্যে পারস্পরিকভাবে এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকে।

অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির মাধ্যমে দেশ দুটির মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য করার পরিকল্পনা নেয়া ও তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে উভয় দেশ লাভবান হয়। সম্প্রতি জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি বা ইপিএ হওয়ার বিষয়ে তোড়জোড় চলছে। ২০২৫ সালের মধ্যে উভয় দেশের মধ্যে এ চুক্তি সম্পাদনের কথা রয়েছে।

জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু দেশ হিসেবে জাপান নানা ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং তথ্য-প্রযুক্তিতে অনবদ্য জাপান ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী। জাপানের বাণিজ্যিক অংশীদার ও বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান বাংলাদেশ।

বাংলাদেশকে সবচেয়ে কম শর্তসাপেক্ষে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বনির্ভরতা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসট্যান্স (ওডিএ) অনুমোদন করেছে জাপান। যুগের পর যুগ ধরে উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা শক্তিশালী হয়েছে। আগামীতে এ সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে। ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজ দেশে সফরের আমন্ত্রণ জানায় জাপান। জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের শুরুতে সেই সফর পরবর্তী সময়ে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে পরিণত হয়।

৫১ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় পরীক্ষিত বন্ধু দেশ জাপান উদারচিত্তে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুনীল অর্থনীতি, মানবসম্পদের উন্নয়ন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করে আসছে। বর্তমানেও জাপানের বহু বিনিয়োগ এবং মেগা প্রকল্প চালু রয়েছে বাংলাদেশে।

১৯৭২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত অর্ধশতাব্দীতে জাপান বাংলাদেশকে ২৪ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক সাহায্য এবং ঋণ হিসেবে দিয়েছে। এশিয়ায় বাংলাদেশী পণ্যের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার হলো জাপান। মূলত গার্মেন্ট ও চামড়াজাতীয় দ্রব্য জাপানে রফতানি করে বাংলাদেশ। জাপান থেকে আমদানির তালিকায় সবচেয়ে বেশি রয়েছে ইস্পাত, লোহা, গাড়ি ও মেশিনারিজ। এসব পণ্যের ব্যবসায় জাপানের একচেটিয়া বাজার হলো বাংলাদেশ। তবে উভয় দেশের মধ্যে সম্ভাবনাময় বিভিন্ন খাতেও বাণিজ্য হতে পারে। যেমন ফার্মাসিটিক্যালস, কৃষিজাত পণ্যদ্রব্য ও ফিশারিজ।

২০১৮-১৯ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে জাপান-বাংলাদেশ আমদানি-রফতানির মধ্যে অল্প কিছু বাণিজ্য ঘাটতি ছিল। রফতানিতে এর পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানিতে ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার। তবে আশার কথা হলো, এ ধরনের ঘাটতি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে দূর করা সম্ভব, যা জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (ইপিএ) মাধ্যমে খুব ভালোভাবেই সম্ভব। মূলত ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার পরও শুল্ক সুবিধা ধরে রাখতে এ চুক্তি প্রয়োজন। আর সেজন্য এরই মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ।

ইপিএ না হলে ২০২৬ সালের পর পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশকে ১৮ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হবে। তাই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দেশগুলোর কাছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে শুল্ক সুবিধা নিতে হলে ইপিএ চুক্তির বিকল্প নেই। সেটা না হলে বাণিজ্যে সুবিধা হারিয়ে প্রতিটি আমদানি পণ্যের অতিরিক্ত খরচের কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে।

জাপানের সঙ্গে ইপিএ চুক্তির মাধ্যমে এরই মধ্যে বহু দেশ দ্বিপক্ষীয় সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ কর্মকর্তারা ২০১৭ সালের ৬ জুলাই এক ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেন। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে ইইউর চাওয়া ছিল—বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাজার, বিশেষ করে জাপানের মোটর শিল্পের বাজারে প্রবেশ করা। অন্যদিকে জাপানের চাওয়া ছিল ১২ জাতির ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপের (টিপিপি) ব্যর্থতা কাটিয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করা।

জাপানের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছিল, তাকে বিশ্ব বাণিজ্যে এক সুদূরপ্রসারী এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বর্ণনা করা হয়। কারণ এ চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠিত হয়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতির মোট জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ এখান থেকেই আসে। সুতরাং এখান থেকে বহু দেশ উৎসাহিত হয়ে নিজ দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দ্বিধা করবে না।

জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ চুক্তির প্রভাবে বিশ্ব বাণিজ্যের ধারায় বদলের হাওয়া লাগে। বিশ্বের সবচেয়ে একক এবং বড় বাজার হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর সদস্য দেশের সংখ্যা ২৮। প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এ বাজারের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে বর্তমানে জাপান বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। কাজেই জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে এ বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন হয়।

এ বাণিজ্য চুক্তির ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে জাপানে পনির বা ওয়াইনের মতো পণ্য রফতানির ওপর শুল্ক প্রায় থাকবেই না। এতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর শুল্ক বাবদ বেঁচে যাবে প্রায় ১০০ কোটি ইউরো। অন্যদিকে জাপানও বিনা শুল্কে ইউরোপীয় বাজারে তাদের গাড়ি এবং যন্ত্রাংশ রফতানি করতে পারবে। এতে করে উভয় পক্ষের অর্থনীতিই বিপুলভাবে লাভের মুখ দেখবে।

মূলত ২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটলে শুল্কমুক্ত সুবিধা উঠে যাবে। আমদানির ক্ষেত্রে তখন আমাদের গড়ে অন্তত ১৮ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে পণ্য রফতানিকালে শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা হারালে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণভাবে আরোপিত শুল্কের সম্মুখীন হতে হবে। এতে বাংলাদেশের রফতানি বাজার সংকোচনের শঙ্কা তৈরি হবে।

এখন দেখে নেয়া যাক, জাপানের সঙ্গে ইপিএ চুক্তি হলে বাংলাদেশের কী লাভ হবে। চলতি বছরের ১২ মার্চ বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু সচিবালয়ে এ বিষয়ক সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে জানানো হয়, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার পরও শুল্ক সুবিধা ধরে রাখতে জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) সইয়ের জন্য আলোচনা শুরু করেছে সরকার। সেই আলোচনায় বাংলাদেশের লাভা-লাভের প্রসঙ্গে বিভিন্ন প্রস্তাব উঠে এসেছে।

চুক্তি হয়ে গেলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের বাইরে বিশ্ববাজারেও জাপান-বাংলাদেশ একসঙ্গে প্রবেশাধিকার চাইতে পারবে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বিশাল বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু হবে না। জাপানি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ যদি সত্যিই বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনে ঢুকতে পারে, সেটা হবে বাংলাদেশী পণ্যের বহুমুখীকরণ ও দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিরাট এক অর্জন।

তাছাড়া ইপিএ কেবল শুল্ক কমানোর মাধ্যমে বাণিজ্যের প্রসার করবে এমনটা নয়। কাস্টমস ছাড়ের প্রক্রিয়া ও ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির মাধ্যমে বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্যের বহুমুখীকরণের পথ তৈরি হবে। চুক্তি হলে বাংলাদেশী পণ্য শুল্কমুক্তভাবে জাপানের বাজারে প্রবেশ করবে। অন্তত ২০২৯ সাল নাগাদ এ সুবিধা যেন পাওয়া যায় সরকারের পক্ষ থেকে সেই চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

নীতিনির্ধারক মহল থেকে যে তথ্য মিলেছে তাতে বলা হচ্ছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আলোচনা শেষ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সেটা সম্ভব না হলে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতেই চুক্তি সম্পাদনের জোর সম্ভাবনা রয়েছে। চুক্তির বিষয়টি যেহেতু এখনো আলোচনাধীন, সেহেতু এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা থাকতে পারে। সেখানে শুল্ক ছাড়াও বিনিয়োগ, পণ্য বাণিজ্য, বাণিজ্য প্রতিকার, রুলস অব অরিজিন, কাস্টমস প্রসিডিউর অ্যান্ড ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন, স্যানিটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানিটারি, শ্রম, ব্যবসায়িক পরিবেশ, স্বচ্ছতা, মেধাস্বত্ব ও ই-কমার্সসহ ১৭টি খাত অন্তর্ভুক্ত রাখার কথা বলা হচ্ছে। 

এদিকে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক জরিপে দেখা গেছে, উভয় দেশে কাজ করছে এমন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮৫ শতাংশ চায়, সরকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সই করুক। কারণ এতে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা প্রবলভাবে বেড়ে যাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

উভয় দেশের বাণিজ্য সুবিধা বৃদ্ধি এবং লাভবান হওয়া প্রসঙ্গে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি বলেছেন, ইপিএ সই হলে কোন দেশ কতটা লাভবান হবে তা অনুমান করে বলা সম্ভব নয়। তবে চুক্তি সই হলে উভয় দেশ সমানভাবেই লাভবান হবে। 

এ থেকে আমরা ধরে নিতে পারি, আর যা-ই হোক জাপানের মতো এত দীর্ঘ সময়ের সুবিশ্বস্ত বন্ধু দেশের সঙ্গে এ চুক্তি হলে বাংলাদেশের লাভ ছাড়া ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই, বরং এটা হতে পারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গেটওয়ে। হয়তো এ চুক্তির মসৃণ পথ ধরে আমরা পৌঁছে যেতে পারি ইইউর মতো সুবৃহৎ একটি বাজারে, যা হবে বাংলাদেশের জন্য অভাবনীয় সৌভাগ্যের।

ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম: চেয়ারম্যান

জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন