সন্ত্রাসমুক্ত নাকি রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস—এভাবে দেখার বাস্তবতা নেই

ছবি : বণিক বার্তা

ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি। ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে বুয়েট শিক্ষার্থীদের অবস্থান নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

বুয়েট ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত থাকবে, এটা কতটুকু যৌক্তিক দাবি?

বুয়েট ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত থাকবে—এটি একটি সুনির্দিষ্ট দাবি। বুয়েট ক্যাম্পাসকে রাজনীতিমুক্ত রাখার দাবি। এটা ঠিক যে বুয়েটের শিক্ষক ও প্রাক্তন ছাত্রদের বিপুল অধিকাংশ এটা চাইছেন। কিন্তু এটা প্রথমত বুয়েটের বর্তমান ছাত্রদের দাবি। ভুল বিবেচনা বা আবেগের বশবর্তী হয়ে তারা এ দাবি করছেন এমন নয়। বিগত দুই যুগে ছাত্রদের সমষ্টিগত (collective) অভিজ্ঞতা থেকে এ দাবি তারা তুলেছেন।

বুয়েটে তাদের অভিজ্ঞতার আর আমার সময়কার অভিজ্ঞতায় পার্থক্য রয়েছে। বুয়েটে আমার শিক্ষা জীবনের শুরু ১৯৮৭ সালে। জেনারেল এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ের সামনে ডাক্তার মিলন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তার পেছনে লাঠি হাতে বুয়েটের ছাত্রদের এক বিশাল মিছিল ছিল। আমার অনেক বন্ধু সেই মিছিলে সামনের সারিতে ছিলেন। সেদিনই পরে আমার এক বন্ধু রাজু গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। সেই সময়ে কিন্তু কাউকে রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি করতে শুনিনি। তার কোনো জোর প্রয়োজন ছিল না। 

রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিটি বুয়েটে কীভাবে জোরালো হলো?

এ দাবি জোরালোভাবে ওঠে ২০০২ সালে, যখন ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সাবেকুন নাহার সনি। এ সংঘর্ষ ছিল টেন্ডার দখল নিয়ে। অর্থাৎ এ সংঘর্ষ ছাত্রদের কোনো প্রকার দাবিসংক্রান্ত তো নয়ই, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো গণতান্ত্রিক দাবি নিয়েও নয়। ২০১৩ সালে ধর্মীয় উগ্রবাদী এক ছাত্র দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দীপ। ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় তাকে। ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আবরার ফাহাদ। ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তির সমালোচনা করায় তাকে নির্যাতন ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। 

আবরার হত্যার জন্য বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীর মৃত্যুদণ্ড এবং আরো পাঁচ শিক্ষার্থীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। ছাত্ররা দেখেছে দুই যুগে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন বা ব্যক্তির হাতে ক্যাম্পাসে তিনজন ছাত্র হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ২০ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। আরো কয়েকজন কারাগারে আটক অথবা পলাতক। বুয়েটে যে ছাত্ররা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় তারা তো কেউ সন্ত্রাসী বা খুনি নয়। অথচ বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ ভয়ংকরভাবে বদলে গেল। ছাত্ররা দেখেছে যে এর আশু কারণ হচ্ছে এমন রাজনীতি ক্যাম্পাসে, যাকে মোকাবেলার সামর্থ্য তাদের নেই। ভালো রাজনীতি আর খারাপ রাজনীতি—এভাবে আলাদা করার কোনো পথ কেউ দেখাতে পারেনি। উপায়হীনভাবে তারা তাই ক্যাম্পাস থেকে রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে। 

এজন্যই আমরা দেখেছি সম্প্রতি বুয়েটের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত একটি জনমত নিরীক্ষণে বুয়েটের ৫ হাজার ৮৩৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫ হাজার ৬৮৩ জন (৯৭ শতাংশ) শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন। বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধের যে দাবি বুয়েট ছাত্ররা করছেন তা যুক্তিসংগত কিনা এটা বুঝতে চাইলে আমার মনে হয়েছে এ প্রেক্ষিত বিবেচনা করাটা সবচেয়ে জরুরি।

দাবি কোনটা হওয়া উচিত, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নাকি রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস?

প্রশ্নটা থেকে মনে হতে পারে রাজনীতি ও সন্ত্রাস বুঝি mutually exclusive, যেকোনো একটিকে বেছে নেয়া চলে। একদল ছাত্র যদি শুধু রাজনীতি করার জন্য সংগঠন করত আর আরেক দল কেবলই সন্ত্রাসের জন্য, তাহলে সেই সুযোগ ছিল। ছাত্রসংগঠনগুলো সন্ত্রাস করার জন্য গড়ে ওঠেনি। বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকবে কিন্তু সন্ত্রাস থাকবে না এমন অবস্থা বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তৈরি করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে গোটা দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কিত। বুয়েটের ছাত্রদের অভিজ্ঞতায় রাজনীতি ও সন্ত্রাস একাকার হয়ে গেছে। "সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নাকি রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস—এভাবে দেখার বাস্তবতা তাই আপাতত নেই।

আবরার ফাহাদ হত্যার পর রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এর পেছনে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও তো দায় আছে। কেবল ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে কেন অভিযোগের তীর?  

এটা মূলত এজন্য যে আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বা জড়িয়ে পড়া সবাই ছাত্র। এ ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন একটি ছাত্রসংগঠনের সক্রিয় নেতা-কর্মীরা। ঘটনা যারা ঘটিয়েছে স্বাভাবিকভাবে তাদেরই সবাই অভিযুক্ত করেছে। কাঠগড়ায় তাই দাঁড়িয়েছে ছাত্ররাজনীতি। অন্যদিকে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে। অতীতে বুয়েটের হলগুলোয় র‍্যাগিংয়ের নামে যে ভয়াবহ নির্যাতন হতো তা বন্ধ হয়েছে। হলের পরিবেশে উন্নতি হয়েছে। এ সমাধানগুলোর জন্য তারা কিছুটা অভিযোগের ভারমুক্ত হয়েছেন। 

অতীতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেভাবে নির্লিপ্ত ও নিষ্ক্রিয় থেকেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে তাতে করে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যে হলের কক্ষে ডেকে নিয়ে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা সম্ভব হয়েছিল। এ নিয়ে যে গভীর অনুসন্ধান করা প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। সে সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বিশেষ একাডেমিক কাউন্সিল সভার দাবি জানালেও তৎকালীন বা পরবর্তী উপাচার্য কেউই তা গ্রাহ্য করেননি। 

সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ, ছাত্ররাজনীতির অনুপস্থিতিতে বুয়েটে ‘‌জঙ্গিবাদ’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ অভিযোগের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন।

বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির অনুপস্থিতিতে এখানে ‘‌জঙ্গিবাদ’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, এটা ঠিক নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে বিভিন্ন সময় ‘‌জঙ্গিবাদী’ তৎপরতা লক্ষ করা গেছে তার ব্যাখ্যা কী? তাদের দমন তো কোনো রাজনৈতিক দল করেনি, রাষ্ট্রীয় বাহিনী করেছে। বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের নামে সন্ত্রাসী তৎপরতা চলছে, তাদের দমনের জন্য সেখানে কি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পাঠানো হয়েছে? এই যে ধর্মীয় উগ্রবাদী ছাত্রের ছুরিকাঘাতে দীপ নিহত হলো, সে সময় তো ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ছিল না। ছাত্ররাজনীতি দীপকে রক্ষা করতে পারেনি। ‘‌জঙ্গিবাদ’ দমনের দায়িত্ব ছাত্রসংগঠনের নয়, সে জন্য রাষ্ট্রীয় বহু সংগঠন রয়েছে।

পুরোপুরি ছাত্ররাজনীতি চালু হলে কি সমস্যা হতে পারে বলে আপনি মনে করছেন? 

যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটের ছাত্ররা এখানে ছাত্ররাজনীতি চাইছেন না সেই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল দুইদিক থেকে। তার একদিকে ছিল বুয়েটের অভ্যন্তরীণ শর্তাবলি, আরেকদিকে ছিল বুয়েট-বহির্ভূত শর্তাবলি। অভ্যন্তরীণ শর্তাবলির পরিবর্তনে বা নিয়ন্ত্রণে বুয়েটের ছাত্ররা কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারলেও বাইরের শর্তাবলি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ অবস্থায় বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালু হলে বাইরের শর্তাবলিই বুয়েটের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এটাই সমস্যা।

ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নাকি গুণগত পরিবর্তন—কোনটা বেশি জরুরি?

ছাত্ররাজনীতি কোনো স্বাধীন ক্যাটাগরি নয়। এটা জাতীয় রাজনীতির অধীন। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগঠনের অধীনে যে ছাত্ররাজনীতি সেখানে পরিবর্তন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে বুয়েটকে রাজনীতিমুক্ত রাখার নামে বুয়েটের ছাত্ররা দেশ ও জনগণের স্বার্থে কখনো কোনো ভূমিকা পালন করবে না, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং বুয়েটের ছাত্রদের অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে। এসব বিবেচনা করে, আমি অন্যত্র যেটা বলেছি এখানেও তা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই। বুয়েটের জন্য দরকার প্রতি বছর ছাত্র সংসদের নির্বাচন। ছাত্ররা স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। কোনো দলীয় পরিচয়ে এ নির্বাচন হবে না। কোনো পোস্টার, লিফলেট, মিছিল থাকবে না। বুয়েট প্রশাসন হল সংসদ ও কেন্দ্রীয় সংসদের প্রার্থীদের পরিচয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে, প্রার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজের বক্তব্য পেশ করবে। এসব বক্তব্য অনলাইনে প্রচার হবে এবং স্থায়ীভাবে থাকবে। যদি জাতীয় কোনো পরিস্থিতিতে কোনো ভূমিকা পালনের প্রয়োজন হয় তা উন্মুক্ত সভার মাধ্যমে ছাত্ররা নির্ধারণ করবে। এর মধ্য দিয়েই এখানে ছাত্রদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা, সহনশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হবে। তারা হয়ে উঠবে সমগ্র জনগণের সন্তান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন