ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল

পরীক্ষায় ঘাটতি ও জরুরি বিভাগের অপূর্ণতায় ব্যাহত বিশেষায়িত সেবা

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

২০০ শয্যার ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

নানা সীমাবদ্ধতার কারণে প্রত্যাশিত সেবা মিলছে না ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে। রোগীদের বেশির ভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করাতে হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। আবার চিকিৎসা পেতে কখনো কখনো ছয় মাসও অপেক্ষায় থাকতে হয়। অভিযোগ আছে জরুরি বিভাগের সেবার মান নিয়েও। বহির্বিভাগের জন্য নির্ধারিত সময়ের বাইরে হাসপাতালে গেলে জরুরি বিভাগে চিকিৎসাসেবা মেলে না। সব মিলিয়ে এখানকার চিকিৎসাসেবায় বড় ধরনের দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। 

সরকারের একমাত্র এ ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের অবস্থান রাজধানীর মিরপুরে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬১ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় ২০ শয্যার হাসপাতাল চালু হয়। বর্তমানে এটি ২০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল। কিন্তু রোগ নির্ণয় ব্যবস্থাপনার অপূর্ণতা ও দুর্বল জরুরি চিকিৎসাসেবার কারণে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এ হাসপাতালে সরজমিনে পরিলক্ষিত হয়নি।

২১ মার্চ হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসেন ফয়সাল আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। রোগ নির্ণয় করতে চিকিৎসক তাকে ব্লাড কালচার, সিবিসি ও ইউরিন পরীক্ষার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালটিতে তিনি এসব পরীক্ষা করাতে পারেননি, যেতে হয়েছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। 

দাঁতের চিকিৎসায় সাধারণত পেরিএপিক্যাল এক্স-রে ও অর্থোপেন্টোমোগ্রাম (ওপিজি) এক্স-রে করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। পেরিএপিক্যাল এক্স-রে সাধারণত দুই বা তিনটি দাঁতের প্রতিচ্ছবি ধারণ করতে পারে। সব দাঁতের প্রতিচ্ছবি ধারণ করতে পারে ওপিজি এক্স-রে। দাঁতের আশপাশের হাড়ে কোনো টিউমার বা অন্য সমস্যা আছে কিনা তাও জানা যায়। কিন্তু এ হাসপাতালের ওপিজি এক্স-রে যন্ত্রটি বর্তমানে নষ্ট।

হাসপাতাল প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০ শয্যার বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) সরকারি এ হাসপাতালে নিয়মিত অস্ত্রোপচার হয়। ১৫০ শয্যা বরাদ্দ রয়েছে দাঁতের যেকোনো সমস্যা ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের জন্য। বাকি ৫০ শয্যার মধ্যে ২৫টি করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে জেনারেল মেডিসিন ও জেনারেল সার্জারির রোগীদের জন্য। সপ্তাহের প্রতি শনিবার জেনারেল সার্জারি বিভাগে অস্ত্রোপচার হয়। রবি থেকে বুধবার চারদিন অস্ত্রোপচার হয় ওরাল ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল রোগীদের। 

হাসপাতাল পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর এ হাসপাতালে সাড়ে তিন হাজার রোগী ভর্তি ছিল। চার হাজারের মতো রোগী চিকিৎসা নিয়েছে জরুরি বিভাগে। আর বহির্বিভাগে পরামর্শের জন্য আসে সাড়ে সাত হাজার রোগী। বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে ১ হাজার ৩৯টি আর ছোটখাটো অস্ত্রোপচার হয়েছে ১৬ হাজার ২০৬টি।

রোগী ও হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জরুরি বিভাগে এখানে চিকিৎসা মেলে শুধু বহির্বিভাগের জন্য নির্ধারিত সময়ে (সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা)। আবার এ সময়ের মধ্যে যেসব রোগী আসে, তাদের বেশির ভাগের শুধু প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুই মেলে। হাসপাতালে ভর্তি নেয়া কিংবা পরবর্তী ধাপের চিকিৎসা খুব একটা দেয়া হয় না।  

চলতি সপ্তাহের দুদিন বিভিন্ন সময়ে জরুরি বিভাগে গিয়ে চিকিৎসাসেবার ভালো ব্যবস্থাপনা চোখে পড়েনি। হাসপাতালের সাততলা ভবনের নিচতলায় জরুরি বিভাগ; রাত ও দিনের সিংহভাগ সময়ে রোগী থাকে না। 

পাঁচজন রোগী ও দুজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জরুরি অবস্থা হলেও সাধারণত রোগীরা এ হাসপাতালে আসতে চায় না। কেননা জরুরি মুর্হূতে চিকিৎসা পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। কোনো রোগী বহির্বিভাগের সময় ছাড়া অন্য কোনো সময়ে জরুরি অবস্থা নিয়ে এলেও ভর্তি করানো যায় না। কেননা বহির্বিভাগের সময় ছাড়া জরুরি বিভাগ বন্ধ থাকে। 

গত সপ্তাহের দুই কার্যদিবসে হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, বহির্বিভাগে যেসব রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এসেছে, তাদের বেশির ভাগেরই পরীক্ষা করাতে যেতে হচ্ছে বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোয়। 

চিকিৎসা নিতে আসা অন্তত ১০ জন এ প্রতিবেদককে জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়। কখনো তিন মাস, কখনো ছয় মাস পরে সময় দেয়া হয়। 

পঞ্চাশোর্ধ্ব গোলাম মোস্তফা এসেছেন দাঁতের স্কেলিং করাতে। তিনি সময় পেয়েছেন এক মাস পরে। তিনি জানান, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাকে বাইরে থেকে করাতে হয়েছে। ডায়াবেটিস পরীক্ষাও এখানে করাতে পারেননি তিনি। 

মাদারীপুর থেকে মিঠুন এসেছেন দাঁতের রুট ক্যানেল করাতে। গত ডিসেম্বরে এসে সময় নিয়ে গেছেন তিনি। মাঝের তিন মাস দাঁতের ব্যথা নিরাময়ে বিভিন্ন ওষুধ সেবন করেছেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইউনাইটেড স্টেটস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলছে, দাঁতের জরুরি অবস্থাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে আঘাতজনিত, সংক্রামক ও পোস্টঅপারেটিভ জটিলতা। যে শ্রেণীভুক্তই হোক না কেন, জরুরি ভিত্তিতে এসব জটিলতা চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। এসব জটিলতা তীব্র সংক্রমণের দিকে ধাবিত হতে পারে। কখনো কখনো শ্বাসনালি, স্নায়ু কিংবা হৃদজটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। দাঁতের জরুরি অবস্থা শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু এ জন্য জরুরি চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপস্থিতিও নিশ্চিত করতে হবে।

শরীরের যেকোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. আবুল কালাম বেপারী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে জরুরি বিভাগ যতটা গুরুত্ব পায়, ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ততটা পায় না। ইমার্জেন্সি সার্জারি, ইমার্জেন্সি ভর্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দাঁত ও মুখমণ্ডলের জরুরি চিকিৎসা সব হাসপাতালে কম-বেশি থাকা প্রয়োজন। সেখানে বিশেষায়িত ডেন্টাল হাসপাতালে অবশ্যই থাকতে হবে। এছাড়া জরুরি বিভাগের চিকিৎসায় পরিপূর্ণতা আনতে চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা থাকতে হবে।’

এ অধ্যাপক জানান, ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের বেশি সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়। কোনো কোনো রোগীকে ছয় মাস অপেক্ষায় থাকতে হয় অস্ত্রোপচারের জন্য। এতে যাদের ফেসিয়াল ক্যান্সার রয়েছে, তারা আরো ঝুঁকিতে পড়ে। যেদিন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসবে, জরুরি হলে পরদিনই তার ভর্তির সুযোগ ও চিকিৎসা শুরুর ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আটটি বিভাগের অধীনে হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা দেয়া হয়। এখানে চিকিৎসক, ডেন্টাল সার্জন, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীসহ পদ রয়েছে ৪৩৩টি। জনবল রয়েছে ৩০৫টি পদে। ১২৮টি শূন্য পদ রয়েছে, যা মোট পদের ৩০ শতাংশ। 

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বোরহান উদ্দিন হাওলাদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কিছু পরীক্ষা হাসপাতালটিতে এখন হচ্ছে না। তার মানে এই নয় যে কখনো হয়নি বা হবে না। কোনো মেশিন হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলে কিছুটা বিপাকে পড়তে হয়। তবে বেশির ভাগ পরীক্ষা এখানে করানোর চেষ্টা থাকে। আর জরুরি বিভাগের চিকিৎসা যে হচ্ছে না এমন নয়। বহির্বিভাগ চালু থাকলে রোগীরা বহির্বিভাগেই আসে। বহির্বিভাগের সময় শেষ হলে জরুরি বিভাগে রোগীরা আসে। বিশেষ করে যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন জরুরি বিভাগে রোগী বেশি আসে। কেউ সেবা পায়নি এমনটি হয়নি। আমরা হাসপাতালের সেবার পরিসর বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। ৫০০ শয্যা করার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন