১,৪০০ শাখা-উপশাখা নিয়ে সারা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় আইএফআইসি

আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ এ সারওয়ার ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

প্রচলিত ব্যাংকিং ধারা থেকে বেরিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসি। দেশের বৃহত্তম এ ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন শাহ এ সারওয়ার। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দেশব্যাপী আইএফআইসির বিস্তৃতি, কর্মতৎপরতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ দেশের ব্যাংক খাতের নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

আইএফআইসিকে দেশের বৃহত্তম ব্যাংকিং নেটওয়ার্কে রূপান্তরের প্রক্রিয়া কতটুকু এগোল?

দেশের বৃহত্তম ব্যাংকিং নেটওয়ার্কে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রথমটি হলো সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো। দ্বিতীয়টি হলো সবচেয়ে বেশি মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসা। এরই মধ্যে আমরা প্রথমটি সফলতার সঙ্গে অর্জন করতে পেরেছি। চলতি মাসেই আমরা প্রায় ১ হাজার ৪০০ শাখা-উপশাখা নিয়ে সারা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি। প্রত্যেক উপজেলায় গড়ে তিনটি এলাকায় আইএফআইসি ব্যাংকের সরাসরি উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। এটি কেবলই শুরু। আমাদের চূড়ান্ত সাফল্য আসবে বিস্তৃত এ নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করে। যে পরিকল্পনা ও ব্যয়ের মধ্যে আমরা মডেলটি দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম, সেটিই হয়েছে। এরই মধ্যে জনবল নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের ওপর ভিত্তি করেই আমরা এখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডিজিটাল এনভায়রনমেন্ট তৈরির কাজ করছি।

সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা এ নেটওয়ার্ক মডেল আপনাদের কী সুবিধা দিচ্ছে?

আমরা সমীক্ষা করে দেখেছিলাম, প্রত্যেক উপশাখায় ১০ কোটি টাকার আমানত ও ১ কোটি টাকার ঋণ হলে মডেলটি সফল হবে। এরই মধ্যে আমরা লক্ষ্যের পুরোটাই অর্জন করতে পেরেছি। আইএফআইসির প্রতিটি উপশাখা গড়ে ১০ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করতে পেরেছে। একই সঙ্গে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যও অর্জন হয়েছে। উপশাখার মাধ্যমে আইএফআইসির সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এ মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ একেবারে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের দিতে চেয়েছি। আমাদের লক্ষ্য হলো পাঁচটি মুরগি কিনতে চায় এমন উদ্যোক্তাদেরও ঋণ দেয়া। এ ঋণের সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে হয়তো ১০ লাখ টাকা। এটি হলো বৃহত্তম মডেল তৈরির প্রাথমিক সাফল্য। এ মডেলের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটি বিশ্বমানের ডিজিটাল ব্যাংকিং তৈরি করব। তখন দেখা যাবে, প্রায় দেড় হাজার শাখা-উপশাখা এবং এর সঙ্গে ডিজিটাল সংযোগ দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের সঙ্গে আইএফআইসির সংযোগ ঘটবে। অন্যদের দেখাদেখি আমরা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যাইনি। 

এ মডেলের চিন্তা এল কীভাবে?

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তিই হলো গ্রামীণ অর্থনীতি। আজ থেকে পাঁচ-সাত বছর আগে আমরা একটি জরিপ চালিয়েছিলাম। সে জরিপে আমরা দেখেছি, ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার বড় অংশই প্রকৃত খাতে যায়নি। এটি আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি। অনেক জায়গায়ই এ ঋণের অপব্যবহার হয়েছে। শহরের মতো গ্রামেও একশ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছে। ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ এ মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছেই বেশি গেছে। অর্থাৎ আমরা যে লক্ষ্যে গ্রামে শাখা খুলেছিলাম, সেটি অর্জন হয়নি। এখন আমরা উপশাখার মাধ্যমে একেবারে সরাসরি গ্রামের মানুষের ঘরের পাশে পৌঁছে গেছি। গ্রামের একেবারে সাধারণ দরিদ্র একজন নারী, যিনি মাত্র ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মুরগি পালন করতে চান, তিনিও এখন আইএফআইসি ব্যাংকের উপশাখায় আসতে পারছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে সরাসরি প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের কাছে ব্যাংক ঋণ পৌঁছাতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতি অনেক বেশি উজ্জীবিত হবে। 

গ্রামের একজন মাছচাষী ব্যাংকের কাছে একসঙ্গে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিতে আসবে না। প্রথমে তারা আসবে ৫ লাখ টাকা ঋণ চাইতে। সাফল্য পেলে সে উদ্যোক্তা পরবর্তী সময়ে ১০ লাখ টাকা ঋণ নেবেন। কেউ হয়তো পাঁচটা গরু কিনে খামার করার জন্য ঋণ নেবেন। সফল হলে পরে আরো ১০টা গরু কিনবেন। 

দেশের প্রথম ব্যাংক হিসেবে আইএফআইসি ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘আমার বন্ড’ নামের একটি বন্ড বাজারে এনেছিল। এখন পর্যন্ত এ বন্ডের সাফল্য কেমন?

‘আমার বন্ড’ পুরোপুরি সফল হয়েছে। বন্ড ইস্যুকারীর লক্ষ্য ছিল এ বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে ১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা। সেটি অনেক আগেই অর্জন হয়েছে। এখন প্রতি মাসেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের রিটার্ন পরিশোধ হচ্ছে। বন্ডটির ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান হলো শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করেছে। এখন ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। বিখ্যাত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে আর্কিটেকচারাল ডিজাইনও তৈরি করা হয়েছে। সেটি রাজউকের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় আছে। ১৮ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের বিশাল প্রকল্প এটি। ‘আমার বন্ড’ কেবলই শুরু। ফান্ডেড ঋণকে নন-ফান্ডেড ঋণে রূপান্তর করে সরাসরি ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করার এ প্রক্রিয়া ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। 

দেশের ব্যাংক খাতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো মার্জার-অ্যাকুইজিশন। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

যেকোনো বাজার অর্থনীতির সহগামী বিষয় হলো মার্জার-অ্যাকুইজিশন। মার্জার-অ্যাকুইজিশনে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বেশ ইতিবাচক। আমি আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্জার-অ্যাকুইজিশনের জন্য বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করবে। যখন নীতিমালা প্রণয়ন সম্পন্ন হবে তখন মার্জার-অ্যাকুইজিশনের পদক্ষেপ সফল হবে। মার্জার-অ্যাকুইজিশন পদক্ষেপটি সফল হওয়ার জন্য দুটো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটা হলো যে দুটো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মার্জার-অ্যাকুইজিশন হবে তাদের মধ্যে সিনার্জি থাকতে হবে এবং এটা একটা প্রফেশনাল ইন্টারেকশনের মাধ্যমে হতে হবে। গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে চলতি শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল মার্জার-অ্যাকুইজিশন। এ প্রক্রিয়ার জন্য কতগুলো শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলো হলো দুটি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, ফেয়ার মার্কেট ভ্যালু, কর্মীদের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও প্রডাক্ট বৈচিত্র্য। এগুলো মার্জারের টেক্সটবুক বা প্রচলিত শর্ত। 

দেশের দুটি বেসরকারি ব্যাংক এরই মধ্যে একীভূত হওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় আরো কিছু ব্যাংকের নাম শোনা যাচ্ছে। এসব উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন?

যখন কোনো দেশের বৃহত্তম স্বার্থে মার্জার-অ্যাকুইজিশনের প্রয়োজন হয় তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকেই সেটির উদ্যোগ নেয়া হয়। এটি দুভাবে হতে পারে। প্রথমত, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে এমন সহায়তাকারী উদ্যোগ নেয়া এবং দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা ও নীতিছাড়ের ঘোষণা দেয়া, যাতে ব্যাংকগুলো একীভূত হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে, সে প্রেক্ষাপটে এ মুহূর্তে মার্জার-অ্যাকুইজিশন অর্থনীতির জন্য উপযোগী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সঠিক কাজটিই করা হচ্ছে। তারা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে মার্জার-অ্যাকুইজিশনের গতি আনার চেষ্টা করছে। 

আইএফআইসি অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া কিংবা অধিগ্রহণের চিন্তা করছে কিনা?

বর্তমানে শাখা-উপশাখায় দেশের বৃহত্তম ব্যাংক আইএফআইসি। সেবা প্রদানের নেটওয়ার্ক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মক্ষমতা ও বিন্যাস এবং প্রডাক্ট বৈচিত্র্যে আইএফআইসি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাংক। বৃহত্তর অর্থনীতি ও জাতীয় স্বার্থে মার্জার-অ্যাকুইজিশনের প্রয়োজন দেখা দিলে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার-অ্যাকুইজিশন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা পুরো প্রক্রিয়াটি পেশাদারত্ব ও স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী। 

আইএফআইসিকে কোনো দুর্বল ব্যাংক অধিগ্রহণের নির্দেশ দেয়া হলে কী করবেন?

এটি একেবারেই হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন। এ ধরনের কোনো নির্দেশনা এলে সেক্ষেত্রে বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সেটি পরিপালন করব।

আর্থিক খাতের সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৭ কর্মপরিকল্পনাসহ একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?

বাংলাদেশ ব্যাংক যে রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়েছে, সেটি বর্তমান সময়ের জন্য খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক। সুশাসন, জবাবদিহিতা যেকোনো দেশের আর্থিক খাতে থাকতেই হয়। বলা হয়, ব্যাংক খাত হলো যেকোনো দেশের অর্থনীতির প্রধান ঝুড়ি। এ ঝুড়িতে আমদানি-রফতানি, কেনা-বেচা, উৎপাদন, সেবাসহ সব খাতের রেসিডুয়াল ইফেক্ট এসে জমা হয়। আপনি যখন ব্যাংক খাতের বিবর্তনের প্রত্যাশা করবেন তখন রাষ্ট্রের অন্য সব স্তম্ভেও পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যাংক খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরো কিছু স্তম্ভ আছে। বিচার ব্যবস্থা এর অন্যতম স্তম্ভ। শুধু ব্যাংকারদের আইনের মধ্যে আনলে হবে না, ঋণগ্রহীতাদেরও আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। দেউলিয়া আইন সংস্কার করতে হবে। 

সুশাসন নিশ্চিতে আর কোন কোন খাতে সংস্কার করা দরকার বলে মনে করেন?

আর্থিক খাত সংস্কার করতে হলে ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার, বিচার ব্যবস্থা, আইনসভা ও প্রশাসন—পাঁচটি খাতের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। তখন শুধু আর্থিক খাত নয়, বরং সব খাতেই ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। সে পরিবর্তনটি হবে স্থিতিশীল ও দীর্ঘস্থায়ী। আপনি নিজের বাড়ি খুব সুন্দর ও পরিপাটি করে তৈরি করলেন, কিন্তু প্রতিবেশীর বাড়ি ভেঙে পড়ছে, তাহলে সাসটেইনেবল পাড়া তৈরি হবে না। এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ব্যাংক খাতের জন্য যেসব নিয়ম-কানুন করছে, সেগুলো অনেক বেশি সময়োপযোগী ও অত্যাবশ্যকীয়। ব্যাংকারদেরও নিজেদের সুশাসন চর্চার প্রতি নজর দেয়া উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন