তুর্কি শিল্প ঐতিহ্যে মিনিয়েচার

সাফকাত সায়েম

সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদের সিংহাসনে আরোহণ ছবি: কেন্ট অ্যান্টিকুইটিজ

প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সংযোগ বিন্দু তুরস্ক। বছরের পর বছর ধরে আনাতোলিয়া সংস্কৃতির উর্বর কেন্দ্র। উসমানি আমলে তা আরো কাঠামোবদ্ধ হয়। তার প্রমাণ হিসেবেই দাঁড়িয়ে আছে তোপকাপি প্রাসাদ, আয়া সোফিয়া, সুলতান আহমেদ মসজিদসহ হাজারো স্থাপনা। আর রয়েছে দেশের ভেতরে ও বাইরের জাদুঘরে সংরক্ষিত অনন্য সব মিনিয়েচার। 

চতুর্দশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বের পশ্চিম অংশে উসমানি সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় থেকেই চলে মিনিয়েচারে সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল অধিকার করেন সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ। মিনিয়েচারের প্রতি উসমানি সুলতানদের আগ্রহ নিয়ে এখনো অনেক কিছুই জানা বাকি, তবু বেশকিছু সূত্র পাওয়া যায় বিষয়গুলো নিয়ে। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের বিজয়গাথা নিয়ে কবি আহমেদি লেখেন ইসকান্দারনামা। সুলতান প্রথম মাহমুদ ও দ্বিতীয় মুরাদের পৃষ্ঠপোষকতা পান আহমেদি। পরবর্তী সময়ে চিত্রকরদের হাতে এটাই পরিণত হয় মিনিয়েচারে। সম্ভবত উসমানি মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের প্রথম দিককার নজির এটা। ইসকান্দারনামায় মোট ৬৬টি ছবি অঙ্কিত রয়েছে। অধিকাংশ ছবিই আঁকা হয়েছে দুই পৃষ্ঠাজুড়ে। এঁকেছেন কয়েকজন শিল্পী। রঙের ব্যবহার আর তুলির আঁচড়ে মুনশিয়ানা স্পষ্ট। উসমানি শাসনের পরবর্তী দিনগুলোয় মিনিয়েচারের উদাহরণ বাড়তে থাকে। ১৪৫৫ সালে দিলসুজনামা লেখা হয়, যেখানে বলা হয়েছে একটা গোলাপ আর তোতাপাখির ভালোবাসার আখ্যান। 

সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদের লাইব্রেরিতে ভূগোল, চিকিৎসা, ইতিহাস, দর্শন ও অলংকারশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রচুরসংখ্যক বই ছিল। ১৪৬০ ও ১৪৮০ সালের মধ্যে মুসলিম দুনিয়ার বিখ্যাত পণ্ডিতদের বইগুলো ক্যালিগ্রাফারদের দ্বারা নসতালিক, নাসখ ও দিওয়ানি ক্যালিগ্রাফিতে অনুলিপি করা হয়েছিল। সেই শিল্পীদের বেশির ভাগই এসেছিলেন তৈমুরের দেশ থেকে দেশান্তরিত হয়ে। সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ বিপুলসংখ্যক পারসিক ও ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী নিয়োগ দেন তার দরবারে। ইরানিদের মধ্যে ছিলেন শায়খ জাদা, সিয়াভুশ ও ওয়ালি জান। তারা তিনজনই কিংবদন্তি পারসিক চিত্রকর কামাল উদ্দিন বেহযাদের শিষ্য। পাশাপাশি সুলতান ইউরোপীয় রেনেসাঁর অন্যতম চিত্রকর জেন্টাইল বেলিনিকেও আমন্ত্রণ জানান দরবারে। বেলিনি পরবর্তী সময়ে সম্রাটের একটা পোর্ট্রেটও এঁকে দিয়েছেন। এভাবে প্রাচ্য আর প্রতীচ্য সংস্কৃতির একটা মেলবন্ধন ঘটতে থাকে উসমানি দরবার।

উসমানি আমলে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিগুলো হলো সুলাইমাননামা, তারিখ-ই সুলতান-ই বায়েজিদ, শাহিনশাহ নামা, কিয়াফেত আর ইনসানিয়ে ফি সেমাইল ই উসমানিয়ে। এছাড়া ইতিহাস, উপকথা, প্রণয়োপাখ্যান ও জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়েছে এ সময়ে। প্রতিটি পাণ্ডুলিপিই ছিল মিনিয়েচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রসদ। তবে এসবের মধ্যে সুরনামা সবচেয়ে চমকপ্রদ। পুস্তকটিতে আলোচনা করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের উৎসব নিয়ে। তুলে ধরা হয়েছে রাজ্যের অভিজাতদের জমায়েত। এর মধ্য দিয়ে উসমানি শাসকদের ক্ষমতাই ফুটে উঠেছে মিনিয়েচারে। আরো পরে আঁকা সুলাইমাননামায় এশিয়া ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিশেল খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মুরাক্কাস এক বিশেষ ধরনের শিল্প ঘরানা, যার মাধ্যমে উসমানি সুলতানদের জীবনাচার ফুটে উঠেছে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে। তার সঙ্গে জায়গা পেয়েছে নানা প্রাণী, ফুল, গাছ, লতাপাতা। মোগল চিত্রকলার পাশে রেখে পাঠ করলে তাদের চিত্রকর্ম আরো বেশি মানবিক। আরো বেশি বাস্তবতাপূর্ণ, যৌক্তিক ও আধুনিক। তাতে পার্থিব জীবনের তুচ্ছ বিষয়াবলিও ঠাঁই পেয়েছে। 

পনেরো ও ষোলো শতকের দিকে উসমানি মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ে তৈমুরীয় সিরাজ ঘরানার প্রভাব দেখা যায়। ইসফাহান, শিরাজ ও তাবরিজ থেকে ইস্তানবুলে ঠাঁই নিতে থাকেন চিত্রশিল্পীরা। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ ও আককুয়ুনলু শাসকের মধ্যকার রাজনৈতিক সম্পর্ক উসমানি মিনিয়েচারে প্রভাব ফেলেছে। সুলতান উজুন হাসানের পুত্র সে সময় স্বল্পকালের জন্য ইসফাহানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইস্তানবুলে উসমানি সুলতান মুহম্মদের মেয়েকে বিয়ে করেন। ঠিক সে সংযোগের সূত্র ধরেও অনেক চিত্রশিল্পী হেরাত ও সমরকন্দ থেকে অভিবাসন করেছিলেন ইস্তানবুলে। বিশেষ করে যে অঞ্চলগুলো তিমুরীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত ছিল। হামসে-ই নিজামি এ ঘরানার চিত্রকর্মের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হতে পারে। ধারণা করা হয় এর পাণ্ডুলিপি ইস্তানবুলে আনা হয়েছিল পরবর্তী সময়ে। 

ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিশেষ করে ইতালীয়দের সঙ্গে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে উসমানি সুলতানরা ইউরোপের শিল্পজগৎ সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। প্রতিকৃতিতে তাদের আগ্রহ ছিল বহুমুখী। প্রাচীন যুগের রাজাদের মতো তাদেরও তাই সেদিকে অভিমুখী হিসেবে দেখা যায়। ষাটের দশকে সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদের দাবিতে নেপলসের রাজা মাস্টার কোস্তানজো দা ফেররাকে ইস্তানবুলে পাঠান। তিনি সুলতানকে চিত্রিত করেন; সেই চিত্রকর্ম এখনো রয়েছে জাদুঘরে। পরপর আসা ইউরোপীয় চিত্রকররা উসমানি দরবারে ঠাঁই নিতে থাকেন। বিদেশী শিল্পীরা স্থানীয় শিল্পের ওপর প্রভাব ফেলেছিলেন। সিনান বে ও তার শিষ্য আহমেদ শিবলিজাদে চিত্রশিল্পী ছিলেন। তোপকাপি প্যালেস মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে রাখা একটি অ্যালবামে সুলতান মুহম্মদের দুটি স্বাক্ষরবিহীন প্রতিকৃতি রয়েছে, যেখানে শিল্পপ্রীতি ফুটে ওঠে। উসমানি সুলতানদের প্রতিকৃতি এ সময়ে শুরু হয় এবং ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত একটি সক্রিয় ধারা হিসেবে অব্যাহত ছিল; ইস্তানবুলে অন্য যেকোনো ইসলামিক রাষ্ট্রের তুলনায় সুলতানদের প্রতিকৃতি বেশি তৈরি করা হয়েছে। 

উসমানি রাজ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদ প্রশাসন অটোমান প্রাসাদ সংস্থার মধ্যে একটি শিল্পী সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করে, যা আহলে হরফ নামে পরিচিত। উসমানি রাষ্ট্র যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে ছিল, তখন উদারহস্তে পৃষ্ঠপোষকতা দিত এ খাতে। আহলে হরফ বিভিন্ন প্রাসাদ শিল্প ও কারু শিল্প পরিচালনা করত এবং তার জন্য মজুরি পেত। প্রচুর কর্মচারী ছিল তাদের সঙ্গে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ শিল্পী সম্প্রদায় কাজের জন্য প্রাসাদের ব্যয় এবং শিল্পীদের দেয়া অর্থই প্রমাণ করে যে প্রাসাদ প্রশাসন শিল্পকর্মের আর্থিক সহায়তার দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়েছিল। আহলে হরফের অন্তর্ভুক্ত শিল্পীরাও ছিলেন আবার কয়েক ভাগে বিভাজিত। মুসাভির, মুজেহিপ, মুসেল্লিত, চিত্রকর, আলোকযন্ত্র ও বাইন্ডার। মিনিয়েচারিস্ট বা অন্যান্য শিল্পী যারা সুলতানের কাছে কাজ উপস্থাপন করেন, তাদের অর্থ বা সম্মানসূচক পোশাক দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো। যে শিল্পীর কাজটি তৈরি করেছেন তার নাম, সেই কাজের ধরন এবং তার জন্য প্রদত্ত অর্থ রেজিস্টারে নিবন্ধিত হতো। প্রাসাদের প্রত্যেক শিল্পী আহলে হরফের সঙ্গে যুক্ত হোন বা না হোন, প্রশাসনের দাবি অনুসারে কাজ করতে বাধ্য ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকেই শিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী ফর্মগুলোর পাশাপাশি নতুন চেতনার বীজ বপনে দক্ষতার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। এ সময়ের মধ্যে কাজগুলো এমন বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছিল যা তুর্কি শিল্পের জন্য অনন্য। পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রাসাদে ঠিক কোথায় কাজ করেছিলেন সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই। কিছু শিল্পী প্রাসাদের আঙিনায় তাদের কাজ তৈরি করেন। ১৫১৫ সালে আঁকা হয় মানতিকুত তোয়ায়ের। ফরিদ উদ্দিন আত্তারের লেখা বইয়ের সচিত্র উপস্থাপন প্রচেষ্টা। আত্তার যে আধ্যাত্মিক যাত্রার কথা বলেন, তুরস্কের দরবারে মিনিয়েচারে ফুটে উঠেছে সেই আধ্যাত্মিক পথপরিক্রমা। মানতিকুত তোয়ারের পর আরো একটি উদাহরণ দিওয়ান-ই সেলিম। বইটিতে সুলতান সেলিমের অভিযান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তালিকায় যুক্ত হয় শাহনামা, শাহনামায়ে সেলিম খান, শাহনামায়ে সুলতান মুরাদ, তারিখ-ই সুলতান সুলাইমান ও শাহানশাহনামা।  আঁকা হয় গাজওয়ানামা থেকে শুরু করে রাসুল (সা.)-এর জীবনীগ্রন্থের ওপর নির্ভর করে মিনিয়েচার। নক্কশ উসমান ও সায়্যিদ লোকমানের মতো অসংখ্য মুখ অসংখ্যভাবে অবদান রাখতে থাকে। সে দৌরাত্ম্য চলতে থাকে বিশ শতক পর্যন্ত। বিশ শতকের গোড়ার দিকে এসে উসমানি ক্ষমতা ক্ষীণ হতে থাকে। পাশাপাশি ম্লান হতে থাকে মিনিয়েচার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন