জেনেটিক ও নন-জেনেটিক দুই কারণেই কিডনিতে সিস্ট হতে পারে

অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান

অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান

সিস্ট হলো পানি ভর্তি একটা থলে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় টিউমারকে অনেকভাবে ভাগ করা হয়। কিছু টিউমার আছে বেনাইন, কিছু আছে ম্যালিগনেন্ট। এর মধ্যে কিছু আছে ক্যান্সার, আবার কিছু ক্যান্সার না। এই বেনাইন টিউমারের মধ্যে কিছু আছে সলিড, কিছু আছে সিস্ট। সিস্ট হলো এর যে ককটেনগুলো থাকে তা শক্ত না হয়ে পানিজাতীয় হয়। কিডনিতেও এমন সিস্ট হয়। কিডনির সিস্টগুলো কিছু জেনেটিক কারণেও হয়। অর্থাৎ এটা জিন ক্যারি করে ম্যারিনেট হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়ায়। তা এক পাশেও হতে পারে, আবার দুই পাশেও হতে পারে। কিছু সিস্ট আছে সলিটারি সিস্ট, একটা মাত্র সিস্ট। এমনও হলো দুই সিস্ট হলো সলিটারি সিস্ট। অথবা এক কিডনির মধ্যে অনেকগুলো সিস্ট হতে পারে। তবে জেনেটিক ও নন-জেনেটিক দুইটা কারণে হতে পারে। সিস্টের নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। কিন্তু কিছু আছে সলিটারি সিম্পল সিস্ট। অর্থাৎ তার কোনো রক্তক্ষরণ হয় না, শক্ত হয়ে যায় না। যেগুলো দেখলে আমরা চিন্তাভাবনা করি যে এটা সাধারণ সিস্ট না, এ সিস্টগুলো থেকে হয়তো ক্যান্সার হতে পারে। তবে মেজরিটি যে সিস্ট কিডনিতে সেটা সিম্পল সিস্ট হিসেবেই ধরা হয়। এ সিম্পল সিস্টগুলো যদি ছোট হয় তাহলে দেখা যায় সারা জীবন এ ছোট সিস্ট নিয়েই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সে লালন করে যাচ্ছে। এ ধরনের সিস্টের কোনো চিকিৎসাও লাগে না। শুধু আমরা ফলোআপে রাখি। ছয় মাস অন্তর রোগীর একটা আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে দেখি বড় হচ্ছে বা বদলাচ্ছে কিনা। তবে যখন ডাক্তারদের সন্দেহ হয় এ সিস্টগুলো বড় হচ্ছে তখন কোনো সিম্পল আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে এটা ধরা দেয় না। তখন ডাক্তাররা ওইগুলোর জন্য সিটিইউরোগ্রাম, সিটি স্ক্যান করেন। এ পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে সিস্টগুলোর পুরো ক্যারেক্টার বোঝা যায়। 

কিছু সিস্ট আছে অপারেশন লাগে। রক্তক্ষরণ হলে সেটার চিকিৎসা লাগে। চিকিৎসাটা হলো যদি অনেক বড় হয়, লক্ষণ দেখা দেয় বা কিডনিতে প্রেসার দেয়, ব্যথা হয়, এ ধরনের সিম্পল সিস্টগুলোকে ল্যাপারোস্কোপি করা হতো। আগে ডাক্তাররা পেট কেটে সিস্টমুক্ত করতো। ইদানীং এ অপারেশন ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে করা যায়।

কমপ্লিকেটেড সিস্ট হলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া। ডাক্তারের যদি মনে হয় এটা ক্যান্সারের রূপ ধারণ করতে পারে তখন তারা বায়োপসি নিয়ে তার অপারেশন করেন। তখন দেখা যায় সিস্টসহ একটা অংশ কেটে ফেলে দেয়া হয়। যদি ক্যান্সারটা পুরো কিডনিতে থাকে তাহলে পুরো কিডনিটাই ফেলে দিতে হয়। এ রকম পরিস্থিতিও অনেক সময় হয়। 

তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মেজরিটি সিস্ট সিম্পল। আর এ সিম্পল সিস্টগুলোকে ফলোআপে রাখা হয়। ছয় মাস অন্তর একটা আল্ট্রাসনোগ্রাফি করতে বলা হয়। 

সিম্পল সিস্ট হয় বা মাল্টিপল সিস্ট হয়, আমরা ছয় মাস পরপর একটা ফলোআপ করি। সেখানে দেখি এটা বদলাচ্ছে কিনা। এছাড়া কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। এ ধরনের লক্ষণগুলো দেখলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। 

ডায়ালাইসিস

মানুষের শরীরে দুটি কিডনি। একটি কিডনি যদি নষ্ট হয়ে যায় আরেকটা কিডনি যদি ভালো থাকে, তাহলে সে সারা জীবন স্বাভাবিকই থাকে। তার কোনো ডায়ালাইসিস বা অন্য কোনো চিকিৎসা লাগবে না। যদি কোনো কারণে তার দুটি কিডনি কাজ না করে, সেটা ইনফেকশন দিয়ে হোক, অন্য যেকোনো কারণে নষ্ট হলো তখন চিকিৎসা পদ্ধতি দুটি—১. ডায়ালাইসিস, যেটা নিজে নিজে করতে হয় অথবা ২. কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন। 

বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা

বাংলাদেশের কিডনিতে সিস্টের চিকিৎসায় খুবই কম খরচ। সিম্পল আল্ট্রাসনোগ্রাফি থেকে এর ফলোআপটা করা হয়। এতে বেশি হলে ৫০০-৮০০ টাকা লাগে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো চিকিৎসা লাগে না। আর যাদের চিকিৎসা লাগবে সেটা যদি জেনারেল চিকিৎসা হয়, তাহলে ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে, সেটা খুব একটা বেশি খরচ হয় না বাংলাদেশে। এটা বাংলাদেশে পর্যাপ্ত। অনেক হাসপাতালেই আছে। এটা করতে খুব একটা ব্যয়ও হয় না। 

ডায়ালাইসিস সপ্তাহে দুই-তিনবার করতে হয়। সেটা অবশ্যই ব্যয়বহুল। একেকটা সেশন একেক সেন্টারে একেক রকম। দেড় হাজার থেকে ৪-৫ হাজার, ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত লাগে। তারপর প্রতি ডায়ালাইসিসের আগে অনেক পরীক্ষা করতে হয়, ড্রাগ নিতে হয়। খুবই ব্যয়বহুল এ ডায়ালাইসিস। ডায়ালাইসিসের একেকটা সেশনে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগে। মেজরিটি জায়গায় ডায়ালাইসিস সেন্টার নেই। অনেক উপজেলায় নেই, অনেক জেলায় নেই, বিভাগীয় শহরে আছে। এটা অপ্রতুল, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। 

কিডনির সুস্থতা

কিডনি সুস্থ রাখার জন্য প্রথমেই দেখতে হবে যে তার কোনো ডায়াবেটিস আছে কিনা, তার কোনো হাইপারটেনশন আছে কিনা বা উচ্চ রক্তচাপ। এ দুটো হলো বর্তমান যুগের কিডনির সবচেয়ে বড় শত্রু। কিডনিকে ভালো রাখতে হলে এ দুটিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

অনেকের ইনফেকশন হয় কিডনিতে। ইনফেকশনটাও খুব দ্রুত ডায়াগনোসিস করতে হবে। এটার চিকিৎসা করতে হবে। 

ব্যথানাশক ওষুধ যেভাবে সেভাবে খাওয়া উচিত না। ব্যথানাশক অনেক ওষুধ আছে যা কিডনির ক্ষতি করে। 

কিডনির সুস্থতার জন্য খাবারটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেমিক্যাল অনেক ক্ষতিকর। আমাদের যে এনভায়রনমেন্টাল পলিউশন, এগুলোও খুব ভয়ংকর। পানিতে, পরিবেশে, খাবারে যে কেমিক্যাল থাকে সবকিছু মিলিয়ে আসলে কিডনির ক্ষতি হয়। কারো যদি কিডনির পয়েন্ট বেড়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে তার কিডনিটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। রোগীদের অবশ্যই খাবার নিয়ন্ত্রণ করা লাগবে। এ খাবারের মধ্যে হলো পানি খুব বেশি খাওয়া লাগবে। দৈনিক দেড় লিটার পানি খেতে হবে। অনেক খাবার আবার আমরা নিষেধ করে দিই। যে খাবারে নিয়ন্ত্রণ রাখতে বলি—মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল ইত্যাদি। অ্যান্টিবায়োটিকও কম খাওয়া উচিত। 

এছাড়া কিডনি সুস্থ থাকলেও হুটহাট করে অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া ঠিক না। 

লেখক: অধ্যাপক, ইউরোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জনস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন