শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তি সংগ্রাম বাঙালির অপরিসীম ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। মুষ্টিমেয় কিছু লোক ব্যতীত সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ছিল। কেউ যুদ্ধ করেছে, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে, কেউবা নির্যাতিত হয়েছে। বলতে গেলে বাংলার মানুষ কোনো না কোনোভাবে হানাদার পাকসেনাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সার্বিকভাবেই ছিল একটি জনযুদ্ধ। ত্রিশ লাখ মানুষকে পাকবাহিনী হত্যা করেছে, প্রায় দুই লাখ মা-ভগ্নি ইজ্জত খুইয়েছে, বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নিরপরাধ মানুষের ওপর এমন অত্যাচার পৃথিবীতে বিরল।

মূলত পাক সামরিক বাহিনীর বাঙালি নিধন শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন বড় শহরে অপারেশন সার্চলাইটের আড়ালে গণহত্যার মাধ্যমে। ঢাকায় আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল ছিল পিলখানার ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হানাদার বাহিনী প্রতিবাদী ছাত্র ও শিক্ষকদের নির্বিচারে হত্যা করে।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড: মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস দেশের জ্ঞানী-গুণী, শিক্ষিত ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের তুলে নিয়ে হত্যা করে। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপকতা ছিল যুদ্ধ শেষ হওয়ার শেষের দিনগুলোয়। এটি ছিল এক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে পারে যে বাংলাদেশের মাটিতে তাদের যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়, তখন নবপ্রতিষ্ঠিতব্য বাংলাদেশকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসাবিজ্ঞান তথা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল এবং পঙ্গু করে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নিরপরাধ বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করে। মূল হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ১৪ ডিসেম্বর রাতে। এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের নিয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে ঢাকাকে ঘিরে ফেলেছে। যেকোনো সময় ঢাকার পতন হতে পারে। জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে পূর্ববাংলায় নিয়োজিত পাকবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা তখন ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আত্মসমর্পণ নিয়ে নেগোসিয়েশনে ব্যস্ত। এরই মধ্যে তারা গোপনে এ দেশীয় দোসর কুখ্যাত রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর মাধ্যমে ১৪ ডিসেম্বর দিনে ও রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বিশিষ্ট শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী প্রভৃতি জ্ঞানী-গুণী লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের পর নির্দিষ্ট কয়টি বধ্যভূমিতে হত্যা করে। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর নিকটাত্মীয় ও স্বজনরা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ শনাক্ত করেন। অনেকের হাত-পা ও চোখ বাঁধা, দেহে নির্যাতনের চিহ্ন। কাউকে গুলি করে, আবার কাউকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। অনেকের লাশ শনাক্ত করা যায়নি, আবার অনেকের লাশ পাওয়া যায়নি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মার্চে পরিচালিত অসহযোগ ও গণআন্দোলনে এবং পরবর্তী সময়ে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে উৎসাহ দেয়া ও উজ্জীবিত রাখার ক্ষেত্রে এ দেশের কবি-সাহিত্যিক, সংগীত ও চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রকার, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক প্রমুখ বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাদের নিধন ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা বিশ্বের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক কালো অধ্যায় সৃষ্টি করে। 

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন: বলতে গেলে ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সঙ্গেই বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করা। সে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষককে হত্যা করা হয়। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা সামরিক বাহিনী আলবদর ও আলশামস একটি তালিকা প্রস্তুত করে, যেখানে প্রগতিশীল, স্বাধীনতাকামী এসব বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায় এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। স্বাধীনতার পর বঙ্গভবন (সাবেক গভর্নর হাউজ) থেকে তার সহস্তে লিখিত একটি ডায়েরি পাওয়া যায়, যেখানে নিহত ও জীবিত অনেক বুদ্ধিজীবী ও কৃতী ব্যক্তির নাম ছিল। বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে হত্যা করার জন্য আলবদরদের ব্যবহৃত গাড়ির ব্যবস্থাও জেনারেল রাও ফরমান আলি করেছিলেন বলে তার ডায়েরিতে উল্লেখ রয়েছে। 

বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিল আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মঈন উদ্দিন। তিনি ছিলেন অপারেশন ইনচার্জ। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার নম্বর লেখা ছিল। আশরাফুজ্জামান খানের গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের দেয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী, রায়েরবাজারের জলাশয় ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমি হতে বেশ ক’জন বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ পাওয়া যায়, যাদের সে নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল। পরবর্তী সময়ে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ দুজনকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। কিন্তু তারা স্বাধীনতার পর পরই (যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র) পালিয়ে যান। এছাড়া অন্য যারা প্রধানত বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ছিল তারা হলো এবিএম খালেক মজুমদার, মাওলানা আবদুল মান্নান, আবদুল কাদের মোল্লা প্রমুখ। বিভিন্ন সমর্থিত সূত্র হতে এসব তথ্য পাওয়া যায়। 

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা: বাংলাপিডিয়া হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা ছিল নিম্নরূপ: 

শিক্ষাবিদ ৯৯১

সাংবাদিক ১৩

চিকিৎসক ৪৯

আইনজীবী ৪২

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, প্রকৌশলী ১৬ 

তবে এ তালিকা-বহির্ভূত আরো সুশীল ব্যক্তিরা থাকতে পারেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। 

২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ হারান, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন: 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক:

১। গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র)

২। মুনীর চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য) 

৩। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য) 

৪। আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য) 

৫। আবুল খায়ের (ইতিহাস)

৬। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য) 

৭। সিরাজুল হক খান (শিক্ষা)

৮। এএনএম ফাইজুল হক খান মাহী (শিক্ষা)

৯। হুমায়ূন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য)

১০। রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য) 

১১। সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা)

১২। ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান)

১৩। এনএম মনীরুজ্জামান (পরিসংখ্যান)

১৪। এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা)

১৫। শরাফত আলী (গণিত)

১৬। এআরকে খাদেম (পদার্থবিদ্যা)

১৭। অনুদ্বৈপয়ান ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা)

১৮। এম সাদেক (শিক্ষা)

১৯। এম সাদত আলী (শিক্ষা)

২০। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস)

২১। গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস)

২২। রাশীদুল হাসান (ইংরেজি)

২৩। এম মর্তুজা (চিকিৎসক)

 রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

 ১। হাবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ) 

২। শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত) 

৩। মীর আব্দুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)

চিকিৎসক 

১। মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ)

২। আব্দুল আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ)

৩। শামসুদ্দিন আহমেদ 

৪। হুমায়ুন কবির

৫। আজহারুল হক

৬। সোলায়মান খান

৭। আয়েশা বদেরা চৌধুরী 

৮। কসির উদ্দিন তালুকদার

৯। মনসুর আলী 

১০। মোহাম্মদ মুর্তজা 

১১। মফিজউদ্দিন খান 

১২। জাহাঙ্গীর 

১৩। নুরুল ইমাম 

১৪। এস কে লালা 

১৫। হেমচন্দ্র বসাক 

১৬। ওবায়দুল হক 

১৭। আসাদুল হক 

১৮। মোসাব্বের আহমেদ 

১৯। আজহারুল হক (সহকারী সার্জন)

২০। মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক)

অন্যান্য 

১। শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক) 

২। নিজামুদ্দিন আহমেদ (সাংবাদিক) 

৩। সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক) 

৪। সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক) 

৫। আ ন ম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক)

৬। আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার)

৭। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রজনীতিবিদ) 

৮। রণদা প্রসাদ সাহা (সমাজসেবক ও দানবীর)

৯। যোগেশচন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)

১০। জহির রায়হান (লেখক চলচ্চিত্রকার)-৩০ জানুয়ারি শহীদ হন

১১। মেহেরুন্নেসা (কবি)

১২। আব্দুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ)

১৩। নজমুল হক সরকার (আইনজীবী) 

১৫। নূতনচন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)

১৬। রমণকান্ত নন্দী (চিকিৎসক ও সমাজসেবক)

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে দুই শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ঘাতকরা হত্যা করে। স্ত্রী-সন্তানদের সামনে থেকে এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া কি মর্মান্তিক! এদিনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতি বছর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর প্রত্যুষে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, সামরিক ও বেসামরিক সিনিয়র কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সমবেত হয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।

বুদ্ধিজীবীরাসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। ১৪ ডিসেম্বরসহ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত ত্রিশ লাখ শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বাংলার স্বাধীনতার জন্য এদের আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন মনে রাখবে। 

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন