ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা

সুনিদ্রার জন্য করণীয়

অধ্যাপক ডা. শংকর নারায়ণ দাস

ফাহাদ মুনিমের বয়স মাত্র ২৭ বছর। এ বয়সেই জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। কয়েক বছর ধরে নিদ্রাহীনতায় ভুগছেন। বছর তিনেক আগে প্রিয়তম মানুষটির সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আঘাতটি বেশ তীব্র ছিল। সারা রাত ঘুম হতো না। দিনে তো নয়ই। বালিশে মুখ গুঁজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকতেন। এরপর আবার করোনা মহামারী! এত মানসিক চাপ নিতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ঘুমের ওষুধ খাওয়া শুরু করেন। তবে এখন আর সেসবে কাজ করছে না। জীবন হয়ে উঠেছে অসহনীয় যন্ত্রণাময়। ফাহাদ মুনিম কেবল একটি উদাহরণ মাত্র। তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে ৪৫ শতাংশের বেশি মানুষ ঘুমের অসুখে আক্রান্ত। করোনার চেয়েও ভয়াবহ মহামারী এটি।

যেসব কারণে হতে পারে অনিদ্রা

নানা রকম শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনিদ্রা হয়। আবার মানসিক কারণেও হয়ে থাকে। স্লিপ অ্যাপনিয়া, ইনসমনিয়ার পাশাপাশি মনোদৈহিক চাপ নিদ্রাহীনতার মূল কারণ।

মানসিক চাপ: পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, কাজ, সংসার, প্রিয় মানুষের সঙ্গে দূরত্ব প্রভৃতি কারণে মানুষ মানসিক চাপে থাকে। কখনো কখনো তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখনই জটিলতা দেখা দেয় স্বাভাবিক জীবনে। শুরু হয় নিদ্রাহীনতা।

ভুল জীবনযাপন পদ্ধতি: অনেকেই দেরিতে ঘুমোতে যান। ঘুম থেকে ওঠেন দেরিতে। ঘুমোনোর সময় শুয়ে শুয়ে মোবাইল চালান, টিভি দেখেন বা বই পড়েন। রাতের খাবারে অনিয়ম করেন। কখনো পরিমাণে বেশি খেয়ে থাকেন। ঘুমানোর আগে চা-কফি পান করেন। অভ্যাসগুলো দীর্ঘকালীন নিদ্রাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ব্যক্তিগত জীবনে জটিলতা: অসুখী দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক কলহ, কর্মক্ষেত্রে জটিলতা প্রভৃতি অনিদ্রার বড় কারণ।

ধূমপান ও মদ্যপান: মদ, নিকোটিন প্রভৃতি নেশাজাতীয় দ্রব্য ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী ম্যালাটোনিন হরমোনের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। ফলে অতিরিক্ত মদ্যপান বা ধূমপান ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: অনেক সময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলেও নিদ্রাহীনতা হয়ে থাকে।

নিদ্রাহীনতায় যেসব অসুবিধা হয়ে থাকে—

প্রচণ্ড মাথাব্যথা

শরীর দুর্বল হয়ে যায়

সারা দিন ঘুম ঘুম ভাব

কাজে-কর্মে উদ্যম কমে যায়

মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে

স্মরণশক্তি কমে যায়

রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস পায়

উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, আলঝেইমার, মস্তিষ্কের রোগসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

বয়স অনুযায়ী ঘুমের সময়

শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘুম অপরিহার্য। এ ঘুম যথাযথ নিয়ম মেনে পর্যাপ্ত পরিমাণে হওয়া জরুরি। অতিরিক্ত ঘুমানো বা কম ঘুমানো দুটোই ক্ষতিকর।

৬-৯ বছর বয়সীদের অন্তত ৯-১১ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।

পূর্ণবয়স্কদের জন্য ৮-৯ ঘণ্টা এবং

৬৫ বছরের অধিক বয়সীদের জন্য ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।

সুনিদ্রার জন্য নির্দেশনা

ধারাবাহিকতা, গভীরতা ও পর্যাপ্ততা—এই তিনটি ব্যাপার নিশ্চিত হলে তবেই তাকে সুনিদ্রা বা সাউন্ড স্লিপ বলা যায়। সুস্থ জীবনের জন্য সুনিদ্রা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে মেনে চলুন নিম্নোক্ত নির্দেশনা—

কাজের সঙ্গে সমন্বয় করে ঘুমের রুটিন করে নিন।

নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন নিশ্চিত করুন। দ্রুত ঘুমোতে যাওয়া, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করুন।

প্রতিদিন একই সময় ঘুমোতে যান। তাতে ঘুমের স্বাভাবিক সাইকেল ঠিক থাকবে।

ঘুমানোর সময় ফোন চালানো, টিভি দেখা, বই পড়া থেকে বিরত থাকুন।

নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খান। সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করবেন।

ঘুমানোর অন্তত ৫-৬ ঘণ্টা আগে থেকে চা-কফি, ধূমপান করবেন না।

প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা শরীরচর্চা করুন। তবে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবশ্যই নয়।

ঘুমানোর বিছানা কেবল ঘুমানোর জন্যই হোক। বিছানাকে কাজ, পড়া বা আড্ডার জায়গা বানাবেন না।

ঘুমানোর সময় ঢিলেঢালা আরামদায়ক পোশাক পরুন।

ঘরের তাপমাত্রা, সাউন্ড, লাইট অর্থাৎ ঘুমের পরিবেশ যেন সুনিদ্রা-সহায়ক হয়, সেটি নিশ্চিত করুন।

লেখক: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন