ফাঙ্গাল ইনফেকশন

ফাঙ্গাল ইনফেকশনের চিকিৎসা কঠিন হয়ে উঠছে

ডা. আরিফুল বাসার

ছবি : বণিক বার্তা

বিশ্বব্যাপী ছত্রাকজনিত চর্মরোগ মানুষের মধ্যে খুব সাধারণ। আমাদের পরিবেশের প্রায় সর্বত্রই ছত্রাক পাওয়া যায়। এমনকি আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন অঙ্গে কোনো লক্ষণ ছাড়া বসবাস করতে পারে ছত্রাক। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ছত্রাকের সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী এটিকে গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে শতকরা ২০-৫০ শতাংশ মানুষ চর্মের ছত্রাক রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে এ সমস্যা আরো প্রকট।

গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশের অধিক মানুষ তাদের জীবদ্দশায় ছত্রাকজনিত ত্বকের সমস্যায় ভোগে। এ রোগ আমাদের দেশে এতই ব্যাপক যে সর্বপর্যায়ের চিকিৎসকের চিকিৎসা ছাড়াও ওষুধ বিক্রেতা এমনকি অনেক সাধারণ মানুষ নিজে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে ব্যবহার করছে। এতে করে ওষুধের কার্যকারিতা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তবে ছত্রাক সংক্রমণের হার ও এ রোগের জটিলতা নিয়ে আমাদের দেশে সঠিক কোনো তথ্য নেই। 

ছত্রাক সংক্রমণ বলতে আমরা সাধারণ মানুষ অনেক সময় শুধু ত্বকের রোগ ভাবি। কিন্তু এটি ত্বক ছাড়া রক্তে এবং আমাদের শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে যেমন ফুসফুস, কিডনি, মস্তিষ্ক, চোখসহ যেকোনো জায়গায় হতে পারে; যার চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক জটিল, ব্যয়বহুল এবং অনেক ক্ষেত্রে হতাশাজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু ছত্রাক সম্পর্কে সতর্কতা জারি করেছে। যেমন ক্রিপটোকক্কাস নিওফরম্যানস নামের ছত্রাক মস্তিষ্কে প্রাণঘাতী সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এটি সাধারণত পাখির বিষ্ঠা বা দূষিত মাটিতে থাকা ছত্রাকের স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শেও এ ছত্রাক ছড়াতে পারে।

অ্যাসপারগিলাস ফিউমিগ্যাটাস হলো এমন একটি ছত্রাক যা ঘরের ভেতরে ও বাইরের পরিবেশে বিদ্যমান থাকে। এটি মরা পাতা, পচন ধরা সবজি, ফলমূল, সংরক্ষিত শস্য এবং ঘরের কার্পেটে জন্ম নিতে পারে। সাধারণত এটি সুস্থ মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে এ ছত্রাক ফুসফুস ও সাইনাসে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

ক্যান্ডিডা অরিস একটি ছত্রাক, যা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয় বিশেষভাবে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি প্রায়ই হাসপাতাল বা ক্লিনিকের মতো স্বাস্থ্যসেবা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা এতে আক্রান্ত হতে পারেন এবং তাদের সংস্পর্শে এলে রোগীরাও সংক্রমিত হতে পারেন। এর আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো এটি অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছে, যা এর চিকিৎসাকে আরো কঠিন করে তোলে।

ক্যান্ডিডা অ্যালবিকানস ছত্রাকজনিত সংক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত। এটি সাধারণত ত্বক, মুখগহ্বর ও যৌনাঙ্গে সংক্রমণ ঘটায়। সাধারণত সুস্থ মানুষের শরীরে এটি সামান্য মাত্রায় উপস্থিত থাকে। তবে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে বা কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এটি অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়ে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। সাধারণত চিকিৎসার মাধ্যমে এ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগতে পারে।

বর্তমান পৃথিবীতে গড় আয়ু বেড়ে যাওয়া, ক্যান্সার রোগের উন্নত চিকিৎসা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনসহ বিভিন্ন আধুনিক চিকিৎসায় ইমিউনো সাপ্রেসিভ বা ইমিউন দমনকারী ওষুধ ব্যবহার করায় শরীরে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। এতে ছত্রাকের সংক্রমণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। যেমন কভিড সংক্রমণের সময় ব্যাপক হারে এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করায় ছত্রাক সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। যদিও এ রোগ সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে হয়, তথাপি দুর্বল পয়োনিষ্কাশন, ঘনবসতি, অপরিচ্ছন্নতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এ রোগ সৃষ্টির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চলতি বছরে রাজশাহী অঞ্চলে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আক্রান্ত রোগীর ৪০ শতাংশ সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। এ রোগের চিকিৎসায় বিগত বছরগুলোয় নতুন কোনো মৌলিক ওষুধ আবিষ্কার না হওয়ায় বর্তমানে ব্যবহৃত ওষুধগুলো গঠনগত পরিবর্তন করে কার্যকারিতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। অতিরিক্ত ওষুধের ব্যবহার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও¡বাংলাদেশে ছত্রাক নির্ণয়ের আধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি একেবারে অপ্রতুল এবং চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। আমাদের দেশে ছত্রাকজনিত রোগের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু গবেষণা হয়েছে, যা মূলত হাসপাতালভিত্তিক ও পরিসংখ্যাননির্ভর। মৌলিক গবেষণার জন্য যথেষ্ট অবকাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি। সেজন্য রোগের ব্যাপকতা, ওষুধের কার্যকারিতা ইত্যাদির জন্য আমাদের বিদেশী গবেষণাপত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে অদূরভবিষ্যতে আমরা হয়তো নিজেরা সক্ষমতা অর্জন করব এবং এ ব্যাপারে সরকার হয়তো গবেষণানির্ভর হাসপাতাল গড়ে তুলবে।

লেখক: সিনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ও তত্ত্বাবধায়ক, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন