ত্বকের ক্যান্সার

ত্বকের ক্যান্সার ও এর নিরাময়

ডা. ফোয়ারা তাসমীম

ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশে একসময় কম হলেও ক্রমেই বাড়ছে। ত্বকের বিভিন্ন কোষের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি থেকেই এর ক্যান্সার সৃষ্টি। সাধারণত পাতলা ত্বক ও হালকা রঙের লোকদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি। তাই স্বভাবতই আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এই ক্যান্সার তুলনামূলক কম। স্কিন ক্যান্সার ধীরে ধীরে বড় হয়, মৃত্যুঝুঁকি অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় কম এবং কারো কারো হয়তো ধারণা, এটি পশ্চিমাদের অসুখ, তাই আমাদের মধ্যে এর সচেতনতা কম। কিন্তু নানা পরিবেশগত কারণে কয়েক বছর ধরে এই ক্যান্সার বেড়ে চলেছে।

জেনে নেয়া যাক এর কারণ, কখন ও কাদের এই ক্যান্সার রোগের সম্ভাবনা‌ বেশি। কোনো সুনির্দিষ্ট একটি কারণে এ রোগ হয় না। কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বা Ultra Violet Ray। বিশেষত যদি দীর্ঘদিন, দীর্ঘসময় ধরে ত্বক এ রশ্মির সংস্পর্শে আসে তাহলে ক্যান্সার ঝুঁকি বেড়ে যায়। পশ্চিমা দেশের মানুষের জীবনযাপন, ত্বকের চরিত্র, পোশাক ইত্যাদি কারণে ঝুঁকি বেশি। সাধারণত সূর্যালোক বেশি পড়ে, যেমন মুখ, বাহু, হাত, পা এসব অংশে ত্বকের ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। এছাড়া বুক, ঘাড়, হাতের তালু, পায়ের তলা, হাতের আঙুলে, হাত-পায়ের নখের নিচেও দেখা দিতে পারে। 

নানা কারণে আমাদের বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসতে হয়। বিভিন্ন ধরনের স্প্রে, কেমিক্যালস, মানহীন প্রসাধন সামগ্রী, রঙের ব্যবহার দীর্ঘ সময় ধরে হলেও ত্বকের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বহুদিন, বহু বছর ধরে আর্সেনিক যুক্ত টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করার ফলে বাংলাদেশের মানুষের শরীরের এক বা একাধিক অংশে ক্যান্সার দেখা দিয়েছে। 

এছাড়া অন্যান্য ক্যান্সারের মতো ধূমপান বা নিকোটিনের ব্যবহার স্কিন ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। বিশেষত মুখমণ্ডলের SCC বা Squamous Cell Carcinoma‌-এর ক্ষেত্রে তামাক একটি বড় কারণ। এ তামাক শুধু সিগারেট বা বিড়ি হিসেবে খাওয়া নয়, যেকোনোভাবেই এর ব্যবহার থেকে হতে পারে। ইদানীং অনেকে নিকোটিনের ভ্যাপার নিচ্ছেন। এছাড়া গুল, জর্দার ব্যবহার তো রয়েছেই।

মূলত তিন ধরনের ত্বকের ক্যান্সার আমরা পেয়ে থাকি। ক্যান্সারের প্রকারভেদে এগুলো লক্ষণ, কী করণীয়, চিকিৎসা ও তার ক্ষতিকারক দিক এবং ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। 

কী কী লক্ষণ দেখলে সন্দেহ করবেন যে ত্বকের ক্যান্সার হয়ে থাকতে পারে 

হঠাৎ কোনো তিল বা দাগের পরিবর্তন আসতে পারে, তিলটি হালকা বাদামি বা গোলামি হয়ে গেছে অথবা আরো গাঢ় কালো হয়ে গেছে অথবা নতুন করে চামড়ায় ছোট গুটির মতো তৈরি হয়েছে এবং সেই জায়গায় চুলকাচ্ছে, ব্যথা হচ্ছে কিংবা ইনফেকশন হচ্ছে, শুকোচ্ছে না। সেই lesion ত্বকের লেভেল থেকে উঁচু হয়ে যাচ্ছে। মসৃণ ধারটি এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে অনেক সময় সেখান থেকে রক্তও পড়তে পারে। 

অথবা একটি পুরনো পোড়া বা দুর্ঘটনার ক্ষত ছিল, বিভিন্ন সময় বারবার জয়েন্টের কাছে থাকার কারণে নড়াচড়ার ফলে একসময় সেখানে বড় ক্ষতের সৃষ্টি হলো কিন্তু নানা চিকিৎসায়ও ভালো হচ্ছে না। 

উপরের সমস্যাগুলো হলে আপনি ভাবতে পারেন হয়তো ত্বকের ক্যান্সার হয়েছে। স্কিন ক্যান্সারের ভালো একটা দিক হচ্ছে, এটি খুব বেশি শরীরের অন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে ছড়ায় না, বিশেষ করে BCC SCC। কিছু SCC ছড়ায় ক্যান্সারটির আশপাশের অংশে এবং লোসিকা গ্রন্থি বা Lymph nodes-এ। একমাত্র ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা চিকিৎসা না করালে দ্রুত অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ত্বকের ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব যদি সঠিক নিয়মে ও মাপে এটিকে অপসারণ করা যায়।

কোথায় যাবেন ও কার পরামর্শ নেবেন

আপনি পরামর্শ ও চিকিৎসার জন্য অবশ্যই একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ, সার্জন বা প্লাস্টিক সার্জনের পরামর্শ নেবেন। তারা ক্যান্সার নির্ণয় এবং চিকিৎসায় আপনাকে সাহায্য করবেন। একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অপারেশনের মাধ্যমে ক্যান্সার অপসারণ করাতে হলে সার্জনের কাছে রেফার করবেন। কখনো কখনো লক্ষণ দেখে, ক্ষেত্র বিশেষে বায়োপসির মাধ্যমে সঠিক ডায়াগনসিস সম্ভব। মনে রাখতে হবে কোন ওষুধ খেয়ে বা মলম ব্যবহার করে ক্যান্সার সারানো সম্ভব নয়। ক্যান্সারটি যখন মুখমণ্ডলে, চেহারার গুরুত্বপূর্ণ অংশে কিংবা অনেক বড় আকারে হয় তখন সেটি অপসারণের পর ত্বকে বড় ক্ষত তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে চামড়া বা চামড়াসহ পুরু টিসু প্রতিস্থাপন করে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে যেতে বিশেষজ্ঞ সার্জনের শরণাপন্ন হতে হবে। আশার কথা এই যে প্রাথমিক পর্যায়ে সার্জারির মাধ্যমে পুরো ক্যান্সারটি সরিয়ে ফেলতে পারলে অন্য থেরাপি লাগে না। বাংলাদেশে নানা কারণে এ ত্বকের ক্যান্সার বাড়ছে, কিন্তু এর সঠিক ডায়াগনসিস ও চিকিৎসাও আমাদের দেশে সফলতার সঙ্গে হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন পুরনো সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল‌ এবং অনেক বেসরকারি হাসপাতালেও‌ এর চিকিৎসা হয়।

আমাদের প্রথমেই চেষ্টা করতে হবে যেসব কারণে এ রোগ হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা, যেমন আল্ট্রা-ভায়োলেট রে সমৃদ্ধ রোদে বেশিক্ষণের জন্য না যাওয়া, যদি প্রয়োজনে যেতেও হয় সেক্ষেত্রে সানস্ক্রিন, টুপি, ছাতা ব্যবহার করা। এছাড়া পরিবেশ দূষণ, রেডিয়েশন, মানহীন প্রসাধন ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। তার পরও ত্বকের ক্যান্সারের লক্ষণ মনে হলে সময়ক্ষেপণ না করে বিশেষজ্ঞ চিকিসৎকের পরামর্শ নিয়ে সম্পূর্ণ নিরাময় লাভ করুন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

বার্ন, প্লাস্টিক, রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারি বিভাগ,

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন