ত্বকের ক্যান্সার

বাড়ছে ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি: চাই সচেতনতা

ডা. মো. আব্দুল মান্নান

ত্বকের ক্যান্সার হয় অস্বাভাবিক কোষ বিকাশের কারণে, যা শরীরের অন্যান্য অংশে আক্রমণ করা বা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। ২০২০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে স্কিন ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা ৮৫৩ বা মোট মৃত্যুর দশমিক ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। প্রধানত তিন ধরনের ত্বক ক্যান্সার রয়েছে—স্কিন ক্যান্সার বেসাল (বিসিসি), স্কোয়ামাস সেল স্কিন ক্যান্সার (এসসিসি) ও মেলানোমা। প্রথম দুটি সাধারণ ত্বক ক্যান্সার। এ দুটি ক্যান্সার নন-মেলানোমা স্কিন ক্যান্সার (এনএমএসসি) নামে পরিচিত।

বেসাল সেল ধীরে ধীরে বাড়ে এবং এটি তার চারপাশের টিস্যুর ক্ষতি করতে পারে। তবে দূরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে যাওয়া বা মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা কম। স্কোয়ামাস সেল ক্যান্সার ছড়িয়ে যাওয়া়র আশঙ্কা বেশি থাকে। সাধারণত এটির মাথায় আঁশযুক্ত একটি শক্ত দলা দেখা যায়। তবে এটি আলসারও তৈরি করতে পারে। মেলানোমা সবচেয়ে আক্রমণাত্মক। এর লক্ষণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত একটি হলো তিল, যা আকার, আকৃতি ও রঙে পরিবর্তন হয়। চুলকানি বা রক্তপাত হয়।

যেসব কারণে ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে

১. সূর্যের অতিরিক্ত এক্সপোজার ত্বকের কোষের ক্ষতি করতে পারে।

২. শরীরে প্রচুর পরিমাণে ক্ষত থাকার কারণে ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

৩. কয়লা ও টারের মতো রাসায়নিকের সংস্পর্শে ত্বকের ক্যান্সার  হতে পারে।

৪. জেনেটিক ফ্যাক্টর থাকলে ত্বকের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

কিছু বিষয় ত্বক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। এ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

ফর্সা ত্বক, সূর্যের অতিরিক্ত এক্সপোজার, রোদে পোড়ার ইতিহাস, মোলের উপস্থিতি, রোদ-জলবায়ু, ত্বকের ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস, দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, বিকিরণের সংস্পর্শ, ক্ষতের উপস্থিতি, ত্বকের ক্ষতিকারক কয়লা, টার ও আর্সেনিকের মতো রাসায়নিকের সংস্পর্শ।

লক্ষণ

বেসাল সেল কার্সিনোমা: ত্বকে উত্থিত মসৃণ, মুক্তা ও স্বচ্ছ বাধা। গলদ বা ক্ষতস্থানে ছোট রক্তনালির উপস্থিতি।

স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা: অনিয়মিত সীমানাসহ লাল দাগযুক্ত ক্ষত। এ প্যাচগুলোয় আলসারেশন ও রক্তপাত।

মেলানোমা: তিলগুলো অসম ও অনিয়মিত। তিলের রঙ বা ব্যাসের পরিবর্তন হতে পারে।লাল ভাব, চুলকানি, আলসারেশন, রক্তপাত।

বিভিন্ন রঙের দাগ বা তিল বাড়তে পারে। বাদামি থেকে কালো পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে।

ত্বক ক্যান্সার নির্ণয়

চিকিৎসক সন্দেহজনক ত্বকের সন্ধান করতে পারেন। তিনি পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্য ত্বকের এ অংশ সরিয়ে ফেলতে পারেন। ত্বক ক্যান্সারে ভুগছেন কিনা তা বায়োপসির মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়।

ত্বকের ক্যান্সারের চিকিৎসার পদ্ধতি

১. এক্সসিশনাল সার্জারি: এ চিকিৎসার জন্য আশপাশের স্বাস্থ্যকর ত্বকের এক প্রান্ত দিয়ে ক্যান্সারজনিত ক্ষয় (কাটা) প্রয়োজন।

২. রেডিওথেরাপি: থেরাপিতে ক্যান্সারজনিত কোষ মারার জন্য এক্স-রে, ইলেকট্রন রশ্মির ব্যবহার করা হয়।

৩. কেমোথেরাপি: এ থেরাপিতে ক্যান্সারযুক্ত কোষগুলো মারার জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসক ত্বকের ওপরের স্তরের ক্যান্সারের জন্য ত্বকে প্রয়োগ করার জন্য অ্যান্টিক্যান্সার এজেন্টের সঙ্গে ক্রিম বা লোশন লিখতে পারেন।

৪. ইমিউনোথেরাপি: এ থেরাপির জন্য ক্যান্সার কোষ পুরোপুরি মেরে ফেলার জন্য শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা ব্যবহার করা প্রয়োজন।

প্রতিকার

১. ত্বক ঢেকে রাখুন। সবসময় বড় হাতার পোশাক, প্যান্ট ও এমন পোশাক পরিধান করুন যা আপনাকে সূর্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করবে। দুপুরের চড়া রোদ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। এক্ষেত্রে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সময়কে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। একান্তই যদি বেরোতে হয়, সেক্ষেত্রে ছায়ায় থাকার চেষ্টা করুন, সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন এবং শরীর ঢেকে রাখুন সম্পূর্ণ।

২. গ্রীষ্মকালে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতি থেকে চোখ রক্ষার জন্য সবসময় সানগ্লাস ব্যবহার করুন। রোদে বেরোলে সানস্ক্রিন মেখে বেরোনো উচিত। অন্যথায় এসপিএফ-৩০যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। শরীরের কোনো অংশ যদি ঢাকা না পড়ে, সেখানেও ভালো করে সানস্ক্রিন লাগান। বারবার বেরোতে হলে ২ ঘণ্টা অন্তর সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। সাঁতার কাটলে বা খুব ঘাম হলেও মুখ ধুয়ে ফের সানস্ক্রিন লাগান।

৩. কৃত্রিম উপায়ে ট্যান করান অনেকে। ওই ট্যানিং বেড থেকে প্রচুর পরিমাণ অতিবেগুনি রশ্মি বের হয়, যা ক্ষতি করে ত্বকের। এতে ত্বক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। তাই বিষয়টি এড়িয়ে চলাই ভালো।

৪. সিএফএল বাল্ব সবসময় হাতের কাছ থেকে বেশ দূরে রাখুন। এমনকি এক ফুট পরিমাণ কাছাকাছি কোনো বাল্বের নিচে বসা উচিত নয়।

৫. কাচের ল্যাম্পশেড ব্যবহার করুন, যা কাপড় বা প্লাস্টিকের চেয়েও অনেক বেশি রেডিয়েশন ফিল্টার করতে পারে।

৬. ভিটামিন-এযুক্ত পণ্য সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করুন এবং কেনার আগে অবশ্যই লেবেলে লেখা দিকনির্দেশনা ভালোভাবে পড়ে দেখুন। অবশ্যই ভিটামিন-এ গ্রহণ করার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। কারণ অত্যধিক পরিমাণ ভিটামিন-এ শরীরের জন্য বিষাক্ত হতে পারে।

৭. ত্বকের ওপর হঠাৎ কালো বা বাদামি ছোপ দেখলে বিষয়টিকে অবহেলা করবেন না। হঠাৎ যদি দেখেন আঁচিলের মতো কিছু একটা গজিয়ে উঠছে, বা গুটি গুটি কিছু দাগ তৈরি হয়েছে, অবশ্যই চিকিৎসক দেখান।

৮. প্রচণ্ড গরমে জুতো খুলে মেঝেতে পা রাখলেও অনেক সময় ছ্যাঁকা লাগে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলেন, কংক্রিটের মেঝে তো বটেই, বালি, জল এমনকি বরফেও সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়। খালি পা রাখলে তা থেকে হতে পারে সানবার্ন। তাই সতর্ক হন আরো।

৯. যথেষ্ট পরিমাণ পানি পান করুন অবশ্যই। ত্বকে পানির জোগান পর্যাপ্ত থাকলে যেকোনো ক্ষতি থেকে সামলে ওঠা যায়।

লেখক: এমবিবিএস, এমডি (ক্লিনিক্যাল অনকোলজি), মেডিকেল ও রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, জুনিয়র কনসালট্যান্ট

ল্যাবএইড ক্যান্সার হসপিটাল ও সুপার স্পেশালিটি সেন্টার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন