স্বাস্থ্য বীমা

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও বাংলাদেশে বীমার প্রচলন

ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার

মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য অন্যতম। এ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমানে ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজের (ইউএইচসি) ধারণা বহুলভাবে স্বীকৃত। ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ হলো বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য অধিকার ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার অর্থ হলো প্রত্যেক নাগরিককে প্রয়োজনমতো সাশ্রয়ী মূল্যে সকল প্রকারের মানসম্মত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা এবং টাকার অভাবে কেউ যেন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। এ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার তিনটি বিশেষ দিক রয়েছে: এক. দেশের সব শ্রেণীর নাগরিককে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসা। দুই. সব ধরনের রোগের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা।  তিন. স্বল্পমূল্যে গুণগত মানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। যাতে কেউ অর্থের অভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। যদি আমরা এই তিনটা বিষয় নিশ্চিত করতে পারি তবেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশ ২০৩০-এর মধ্যে এ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। 

বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিশ্বে অনুকরণীয়। কিন্তু এখনো এ দেশের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের তুলনায় নিজের পকেট থেকে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, এর পরিমাণ শতকরা প্রায় ৬৯ ভাগ। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য তথ্যমতে, এর পরিমাণ শতকরা ৭৪ ভাগের ওপরে। উদাহরণস্বরূপ, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যেমন ভারতে শতকরা ৬৩ ভাগ, পাকিস্তানে ৫৬, নেপাল ও শ্রীলংকায় ৫১ ভাগ। শুধু আফগানিস্তানে নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ব্যয় হয় প্রায় শতকরা ৭৮ ভাগ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিতে নিজের পকেট থেকে শতকরা ৬৯ ভাগ ব্যয় হয়। অর্থাৎ, চিকিৎসাসেবা নিতে যদি কোনো ব্যক্তির মোট ১০০ টাকা খরচ হয় তাহলে তার মধ্যে ৬৯ টাকা ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে খরচ হয়। আর বাকি ৩১ টাকা অন্যান্য উৎস যেমন সরকারের ভর্তুকি, বিভিন্ন স্বাস্থ্য বীমা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা থেকে আসে। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে শতকরা এক ভাগ আসে বিভিন্ন রকমের স্বাস্থ্য বীমা থেকে। এখানে মনে রাখা দরকার যদি কেউ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে তাহলে চিকিৎসা ব্যয় ১০০ টাকা পুরোটাই নিজের পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে প্রতি বছর নতুন করে প্রায় ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে। এর চেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, এ ৬৯ বা ১০০ টাকা তারাই ব্যয় করছে যাদের সামর্থ্য আছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কারো যদি এ খরচ বহন করার সামর্থ্য না থাকে তখন তারা কী করে? তখন সেই ব্যক্তি বা পরিবার তাদের চিকিৎসা খরচ মেটাতে অন্যের কাছে ধারদেনা করে, সম্পদ, আবাদি জমি এমনকি বসতভিটা পর্যন্ত বিক্রি বা বন্ধক রাখে। অন্যান্য খাত থেকেও এ চিকিৎসার চাপ সামাল দেয়।  সম্প্রতি বিআইডিএসের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শতকরা ৫৮ ভাগ মানুষ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে উল্লেখিত পদ্ধতি অবলম্বন করে। আর যারা এভাবেও ব্যয় মেটাতে না পারে তারা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়, যা সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ধারণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর একজন ক্যান্সার রোগীর পেছনে গড়ে ৬ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। শুধু ডায়াবেটিসের পেছনে বছরে গড়ে ২৫,৪০০ টাকা খরচ হয়। আবার ডেঙ্গুর মতো সংক্রামক রোগের পেছনে একজন রোগীর খরচ হয় গড়ে ৪০ হাজার টাকা। এটা বলে রাখা দরকার চিকিৎসা ব্যয়ের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ ব্যয় হয় শুধু ওষুধ কিনতে আর প্রায় ১২ ভাগ ব্যয় হয় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। একটা বিশাল জনগোষ্ঠী এ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।  

সব জনগণকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসতে হলে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য বীমার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য বীমার প্রচলন রয়েছে, যেমন ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বীমা, কমিউনিটি স্বাস্থ্য বীমা, সামাজিক স্বাস্থ্য বীমা, জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা ইত্যাদি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তিগত ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য বীমার ধারণা অনেকটা অকার্যকর কারণ উভয় স্বাস্থ্য বীমায় অংশগ্রহণ ঐচ্ছিক, ব্যক্তিকে নিজের পকেট থেকে নিয়মিত প্রিমিয়াম বা স্বাস্থ্য বীমার চাঁদা দিতে হয় এবং এর ব্যবস্থাপনা করাটাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সামাজিক স্বাস্থ্য বীমা অনেকটা বাধ্যতামূলক। এ পদ্ধতিতে কোনো নির্দিষ্ট গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য বীমা বাধ্যতামূলকভাবে করা হয়। প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়মিত বেতন থেকে এর প্রিমিয়াম বা স্বাস্থ্য বীমার চাঁদা কেটে রাখে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও বাংলাদেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এ স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে কিন্তু এর ব্যবহার এখনো অপর্যাপ্ত এবং সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। বর্তমানে যেটা সবচেয়ে বহুল প্রচলিত এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সেটা হচ্ছে জাতীয় স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থার করা। জাতীয় স্বাস্থ্য বীমায় সব নাগরিক বাধ্যতামূলকভাবে এ স্বাস্থ্য বীমার আওতাভুক্ত থাকবে, সরকারের রাজস্ব বাজেট এবং জনগণের ট্যাক্স থেকে এর অর্থায়ন হবে, সরকারি সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ সেবা চালু করা যেতে পারে। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা বাস্তবায়ন করার জন্য আদৌ তৈরি আছি? আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় জনবল স্বাস্থ্য বীমা চালুর উপযোগী কিনা। আমাদের সেই পরিমাণ অর্থসম্পদ আছে কিনা। আর এ স্বাস্থ্য বীমা বাস্তবায়ন করতেই বা কত টাকা ব্যয় হতে পারে সেটা জানি কিনা। এ স্বাস্থ্য বীমা কীভাবে কাজ করে সেটা নীতিনির্ধারকরা সঠিকভাবে জানেন কিনা। সমাজের জনসাধারণ এ স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে কতটুকু জানে? তাদের মনোভাবই বা কী? আর এ সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা বাস্তবায়ন করবই— বা কীভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সরকারকে যেমন প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে, তেমনি শিক্ষক-গবেষক-চিকিৎসক সবাইকে নিত্যনতুন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ভাবতে হবে। এর সঙ্গে অবশ্যই জনপ্রতিনিধি, সমাজকর্মী, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে তথ্য দিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রান্তিক মানুষের কাছে যেতে হবে, তাদের স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সর্বোপরি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে বাংলাদেশকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে অর্থাৎ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে।

লেখক: স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন