হাইপারটেনশন বা উচ্চরক্তচাপ

উচ্চরক্তচাপ জানুন, নিয়ন্ত্রণ করুন

ডা. শাহজাদা সেলিম

উচ্চরক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার বা হাইপারটেনশন একটি অতিপরিচিত রোগ। সময়মতো রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা না করা হলে উচ্চরক্তচাপ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্বে উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি উচ্চরক্তচাপে ভুগলেও তারা সেই সম্পর্কে অবগত থাকেন না। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত প্রায় অর্ধেক রোগীই জানেন না যে তারা এ রোগে ভুগছেন। 

এ রোগে আক্রান্ত হলে অনেকেই বুঝতে পারেন না কখন কী হয়েছে। অথচ উচ্চরক্তচাপ থাকা সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে ঝুঁকিমুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। এছাড়া সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে সহজেই উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়

উচ্চরক্তচাপের লক্ষণগুলো

অনেকেই উচ্চরক্তচাপের বিভিন্ন রকম উপসর্গ লক্ষ করেছেন বলে দাবি করলেও এটি প্রধানত লক্ষণবিহীন স্বাস্থ্য সমস্যা। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা তা বোঝার উপায় হলো নিয়মিত রক্তচাপ মাপা। রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে রক্ত মাপার যন্ত্র দ্বারা দুটি সংখ্যা রেকর্ড করা হয়:

-           সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার বা চাপ

-           ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেশার বা চাপ

রক্তচাপকে মিলিমিটার (পারদ) বা এমএমএইচজি এককে মাপা হয়। ধরে নেয়া যাক আপনার রক্তচাপ ১২০/৮০ মিলিমিটার (পারদ) তাহলে সিস্টোলিক চাপ হবে ১২০ ডায়াস্টোলিক চাপ হবে ৮০।

একজন মানুষের রক্তচাপ অন্যজনের থেকে আলাদা হতে পারে এবং একই মানুষের দিবসের বিভিন্ন প্রহরে রক্তচাপ ভিন্ন হতে পারে। রক্তচাপ যদি ৯০/৬০ থেকে ১২০/৮০-এই সীমার মধ্যে থাকে তাহলে তা স্বাভাবিক রক্তচাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

 রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় কেন

উচ্চরক্তচাপের নির্দিষ্ট কারণটি সবসময় চিহ্নিত করা যায় না। তবে বিভিন্ন কারণে সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে

-           ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়া

-           অতিরিক্ত লবণ খাওয়া

-           খাবারের তালিকায় যথেষ্ট পরিমাণে শাকসবজি ফলমূল না থাকা

-           অতিরিক্ত পরিমাণে মদপান করা

-           অতিরিক্ত চা-কফি, কোমলপানীয় অন্যান্য ক্যাফেইন-জাতীয় পানীয় খাওয়ার অভ্যাস থাকা

-           পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা

-           ধূমপান করা

-           রাতে একটানা - ঘণ্টার চেয়ে কম ঘুমানো

-           বয়স পঁয়ষট্টি বছরের ঊর্ধ্বে হওয়া

-           পরিবারে বাবা, মা, ভাই-বোনের মতো নিকট আত্মীয়দের হাই ব্লাড প্রেশার থাকা

 উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি

রক্তচাপ ১২০/৮০ থেকে ১৪০/৯০-এর মাঝে থাকলে ভবিষ্যতে উচ্চরক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তা না হলে ঝুঁকি রয়ে যায়, এমনকি তা দিন দিন বাড়তে থাকে।

রক্তচাপ স্বাভাবিকের তুলনায় অত্যধিক বেড়ে গেলে তা রোগীর রক্তনালি, হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি চোখের মতো অঙ্গে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। রক্তচাপ একটানা অনিয়ন্ত্রিত থাকলে মারাত্মক প্রাণঘাতী কিছু রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন

-           হৃদরোগ

-           হার্ট অ্যাটাক

-           স্ট্রোক

-           হার্ট ফেইলিওর, কিডনির সমস্যা

-           পায়ে রক্ত চলাচল কমে যাওয়া। ফলে গ্যাংগ্রিন বা পচা ঘা হতে পারে

-           অ্যাওর্টা নামক দেহের বৃহত্তম ধমনির রোগ

-           মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট ডিমেনশিয়া

রক্তচাপ যৎসামান্য কমানোর মাধ্যমেও এসব ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব।

 প্রতিকার

উচ্চরক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। চিকিৎসক উপযোগী রক্তচাপ মূল্য নির্ধারণ করতে পারেন এবং চিকিৎসা পর্যায় তৈরি করতে সাহায্য করতে পারেন। চিকিৎসা ব্যবস্থার পরামর্শ অনুসরণ করা, নির্দেশনা অনুসরণ করা, ওষুধ সঠিকভাবে নিলে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।

 উচ্চরক্তচাপ কমানোর উপায়

নিয়মিত উচ্চরক্তচাপ দেখা দিলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তা না হলে ঝুঁকি রয়ে যায়, এমনকি তা দিন দিন বাড়তে থাকে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিকিৎসকরা দুটি পথ অবলম্বনের পরামর্শ দেন। প্রথমে জীবনধারায় স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনার উপদেশ দেয়া হয়। এভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না এলে সুস্থ জীবনধারা মেনে চলার পাশাপাশি ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়। তবে রোগ নির্ণয়ের সময় যদি প্রেশার অনেক বেশি থাকে তাহলে শুরুতেই জীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়। জীবনধারায় স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনলে তা উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমায়। এছাড়া এরই মধ্যে উচ্চরক্তচাপ হয়ে থাকলে সেটিও নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। বিভিন্ন রোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে। আপনার জন্য কোন পদ্ধতিটি সবচেয়ে উপযুক্ত তা জানতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 জীবনধারার পরিবর্তন

জীবনধারার কিছু স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন উচ্চরক্তচাপ প্রতিরোধ করতে এবং বেড়ে যাওয়া রক্তচাপ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। এমন কিছু পরিবর্তন হলো

-           খাবারে লবণের পরিমাণ কমানো

-           স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস তৈরি করা

-           মদপান কমিয়ে ফেলা

-           অতিরিক্ত ওজন কমানো

-           নিয়মিত ব্যায়াম করা

-           অতিরিক্ত ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকা

-           ধূমপান ছেড়ে দেয়া।

 লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন