শিশুর শ্রবণশক্তি

বিশ্বে কানে শোনে না সাড়ে তিন কোটি শিশু

অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু

ছবি: ইউনিসেফ

শিশুর বেড়ে ওঠার ধাপগুলোতে প্রধান উপাদান শুনতে পাওয়া। এ সময়ে শিশুর দাঁত ওঠা, হাঁটাচলার পাশাপাশি শব্দের প্রতি সাড়া দিচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখা জরুরি। সাধারণত জন্মের ৬-১২ মাসের মধ্যে শিশু ভাঙা ভাঙা কথা বলতে শুরু করবে। ১৫-১৮ মাসের মধ্যে সহজ কয়েকটি কথা বলতে পারবে। এগুলো যদি না হয়ে থাকে তাহলে মা-বাবা একটু চিন্তিত হয়ে পড়তেই পারেন। যদি স্বাভাবিক নিয়মে শিশুর বেড়ে ওঠার মধ্যে এগুলো দেখা না যায়, তখন অবশ্যই দ্রুত নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। 

ডিফ চাইল্ড ওয়ার্ল্ডওয়াইডের তথ্য বলছে, বিশ্বে ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশু কানে শোনে না আর তাদের ৪০ শতাংশেরই বাস নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। ঠাণ্ডা বা ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার পর শিশু ও নবজাতকদের কানে সমস্যা খুব সাধারণ একটি সমস্যা। প্রচুর তরল খাবার এবং বিশ্রামে বেশির ভাগ শিশুই অল্প কিছুদিনে সুস্থ হয়ে ওঠে। তখন প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হতে পারে। কিন্তু শিশুর বয়স যদি ছয় মাস বা তার কম হয়, দুই কানেই সমস্যা বোধ হয় কিংবা ১০২ ডিগ্রির বেশি জ্বর থাকে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।

শ্রবণশক্তি না থাকার কারণ

নানা কারণে শিশুর শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। বহিঃকর্ণের প্রদাহ যেমন কানে ময়লা জমে যাওয়া, কানে খৈল বা ওয়াক্সের সঙ্গে ধুলাবালি জমে ইয়ার ক্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়া, ভাইরাল ইনফেকশন ইত্যাদি কারণে এমন সমস্যা হতে পারে। অনেক সময় মধ্যকর্ণেরও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। সেগুলো হচ্ছে কান পাকা রোগ, পর্দায় ছিদ্র, মধ্যকর্ণে পানি, পুঁজ বা রক্ত জমে যাওয়া, হাড়ের জোড়ায় সমস্যা, ফুট প্লেট শক্ত হয়ে যাওয়া (অটোসক্লেরোসিস)।

এছাড়া অন্তঃকর্ণের মধ্যে জন্মগত বধিরতা, কানে কোনো টিউমার বৃদ্ধি পেতে থাকলে, কানের অভ্যন্তরে হিয়ারিং সেল নষ্ট হয়ে গেলে শ্রবণশক্তি কমতে পারে। কিছু ওষুধ অটোটক্সিক ড্রাগ হিসেবে চিহ্নিত যেমন অ্যামাইনোগ্লাইকোসাইড, জেন্টামাইসিন ফ্রুসেমাইড (ল্যাসিক্স), অ্যান্টিক্যান্সার, অ্যান্টিটিউবারকুলার ড্রাগ অথবা অ্যাসপিরিন বেশি মাত্রায় দীর্ঘদিন গ্রহণ করা হলে শ্রবণশক্তি কমতে পারে।

লক্ষণ

অনেক সময় শিশু নিজেই কানে ব্যথার কথা বলে। এছাড়া তার আচরণেও পরিবর্তন আসতে পারে। শিশু স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি কান্না বা রাগারাগি করে। তার হালকা বা বেশি জ্বর আসতে পারে। সাধারণত সর্দি হলে বা সাইনাস ইনফেকশন হলে কানে সমস্যা বেশি বোঝা যায়। এছাড়া কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন:

কান টানা: শিশু যদি ঘন ঘন কান টানতে থাকে বা কানে হাত দেয়, তাহলে বুঝতে হবে সে ব্যথা পাচ্ছে। অনেক শিশু নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া এমনিও কান টানে। সেজন্য কান টানার কারণ নিশ্চিত হতে হবে। 

ডায়রিয়া বা বমি: যে কারণে কানে সংক্রমণ হচ্ছে, সে কারণে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনালেও প্রভাব পড়তে পারে। এতে শিশুর ডায়রিয়া বা বমি হতে পারে।

ক্ষুধা কমে আসা: কানে সংক্রমণের কারণে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনালে সমস্যা হয় বলে শিশুদের খাবার গিলতে ও চিবিয়ে খেতে কষ্ট হয়। এমন অবস্থায় শিশুর ক্ষুধা কমে যায়। নবজাতকরা বুকের দুধ বা বোতলে কয়েক চুমুক খেয়ে আর খেতে চায় না।

কানে হলুদ বা সাদা তরল: বেশির ভাগ শিশুর এ লক্ষণ দেখা যায় না। তবে যাদের দেখা দেয়, বুঝতে হবে তাদের কানে সমস্যা গুরুতর হয়েছে। শিশুর কানে এ কারণে গর্তেরও সৃষ্টি হতে পারে।

গন্ধ: শিশুর কান থেকে যদি অপ্রীতিকর কোনো গন্ধ আসে তবে বুঝতে হবে তার কানে সমস্যা হচ্ছে।

ঘুমে সমস্যা: সুস্থ থাকলে শিশুর ঘুমে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু ঘুমানোর সময় সে যদি বিরক্ত করে বা পাশ ফিরে শোয়ার সময় বিরক্ত করে, তবে তার কান পরীক্ষা করা জরুরি। হয়তো কানে ব্যথার কারণে তার ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছে।

জ্বর: কানে ব্যথা থেকে অনেক সময় জ্বরও আসে। তাই সেদিকেও নজর রাখা দরকার। 

চিকিৎসা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় ৪৬ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কানে ঠিকমতো শুনতে পায় না। অনেকে কম শোনে, কেউ আবার জন্মবধির। আংশিক বা সম্পূর্ণ বধিরতা মানুষের ইন্দ্রিয়র সবচেয়ে বড় রোগ। একজন মানুষ জন্মগতভাবে বা জন্মের পর এ সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। 

শ্রবণসংক্রান্ত সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ডেফ’-এর উদ্যোগে ১৯৫১ সালে রোমে প্রথম শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা দিবস পালন শুরু হয়। কানে শুনলে তবেই শিশু কথা বলতে শেখে। কিন্তু জন্ম থেকেই যদি শিশুর কানে কোনো শব্দ না পৌঁছায় তাহলে কথা বলতে শেখার কোনো প্রশ্নই থাকে না। তাই বিসিজি বা অন্যান্য টিকার মতো ইউরোপ-আমেরিকায় সদ্যোজাত শিশুর শ্রবণক্ষমতা পরীক্ষার করা বাধ্যতামূলক।

জন্মের সময় শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক থাকলেও তিন-চার বছর বয়সে মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড বা এনকেফেলাইটিস হলেও শ্রবণক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্য অনেক অসুখের মতোই কানে শোনার সমস্যা যদি জন্মের সময় নির্ণয় করা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হিয়ারিং এইড দিয়ে বা ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করে শিশুকে শব্দের জগতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি এক অভিনব পদ্ধতি। এ চিকিৎসায় যন্ত্রের একটি অংশ সার্জনরা অপারেশন করে রোগীর কানের ভেতর বসিয়ে দেন, যা আমৃত্যু কার্যকর থাকে। বাকি অংশটুকু কানের পেছনে লাগানো থাকে, যা দিয়ে প্রায় স্বাভাবিকের মতোই শব্দ শোনা যায়। কানে জন্মগত সমস্যা থাকলে ১০ মাস থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করা ভালো। তাছাড়া যাদের বয়স বেশি তারাও অপারেশন করালে ভালো শুনতে পাবেন। তবে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট যন্ত্রের দাম অনেক। তাই যন্ত্রটি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত।

চিকিৎসকদের মতে, গর্ভাবস্থায় হবু মায়ের মাম্পস, রুবেলা, হারপিস, চিকেন পক্স বা টক্সোপ্লাসমোসিসের মতো ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ হলে শিশু জন্মগতভাবে শ্রবণক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। গর্ভাবস্থায় মা যদি এমন কিছু ওষুধ খান, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, তখন শিশু বধির হয়ে জন্মাতে পারে। তাই সন্তান ধারণের সময় ওষুধের ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ সময় কোনো ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। 

পরীক্ষা করে যদি জানা যায়, রোগীর শ্রবণ সহায়ক নার্ভ দুর্বল, তবে ছোট বয়সেই ‘হিয়ারিং এইড’ দিতে হবে। ছোট থেকে ‘হিয়ারিং এইড’ নিলে শিশু চট করে মানিয়ে নিতে পারে, ভবিষ্যতেও কোনো সমস্যা হয় না। পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে শিশুর শোনার ক্ষমতা ফিরিয়ে না আনলে স্বাভাবিকভাবে কথা শিখতে ও বলতে অসুবিধা হয়। শিশুর পাশাপাশি বেশি বয়সেও নানা কারণে শ্রবণক্ষমতা লোপ পেতে পারে। চশমার মতোই হিয়ারিং এইড বা ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করে নিলে সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইএনটি অ্যান্ড হেড-নেক সার্জারি বিভাগ 

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন