সুস্থ আছেন নাকি ভেতরে ভেতরে কোনো রোগের শিকার হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন তা বোঝা যায় নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। পরীক্ষায় যদি কোনো বড় রোগের ছোট লক্ষণও ধরা পড়ে, তাহলে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এড়ানো সম্ভব বাড়তি ঝুঁকি।
যেমন হৃদরোগের কথাই ধরা যাক। আগে থেকেই যদি নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে থাকেন তাহলে এ রোগ বড় আঘাত হানার আগেই তা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সম্প্রতি কয়েক বছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপীয় অঞ্চলে প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এমন প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবেই সেখানে জীবনব্যাপী নতুন সব স্ক্রিনিংয়ের কথা উঠে এসেছে। এ অঞ্চলের নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্যবিষয়ক পেশাজীবীরা বারবার প্রমাণ পেয়েছেন যে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হলে জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে আরো উন্নতি করা সম্ভব। আবার এভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই। বুঝেশুনে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে খরচও যে রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরের তুলনায় খুব বেশি হয় বিষয়টা তেমন নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে আরো বলা হয়েছে, উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপে এমন পদক্ষেপ খুবই যৌক্তিক। বেশকিছু পরিস্থিতিতে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেক উপকারীও। বিশেষ করে ক্যান্সার, প্রসবপূর্ব ও নবজাতক অবস্থায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তবে জনগণের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি করার জন্য কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার তা বিবেচনা করতে হবে।
জনস হপকিন্স মেডিসিনের মতে, বেশির ভাগ বয়স্ক ব্যক্তির জন্যই বয়স অনুযায়ী ডাক্তাররা কিছু স্ক্রিনিং শিডিউল দিয়ে থাকেন। যেগুলো দিয়ে শরীরের বেশির ভাগ সমস্যা চিহ্নিত করা যায় যেমন শারীরিক পরীক্ষা, বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই, ত্বক পরীক্ষা, কোলেস্টেরল, রক্তচাপ পরীক্ষা, চোখের পরীক্ষা, টিকা এবং যৌনবাহিত রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
হপকিন্স মেডিসিনের তথ্য বলছে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা সাধারণত করা যায় স্বাস্থ্যগত কোনো ডিজঅর্ডার বা রোগ আছে কিনা বোঝার জন্য। এমনকি যাদের কোনো লক্ষণ নেই তাদেরও এসব পরীক্ষা করানো দরকার। এ ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুরুতেই রোগ চিহ্নিত করা এবং সেই অনুযায়ী জীবনযাপন বা তত্ত্বাবধান পরিবর্তন করে রোগের ঝুঁকি হ্রাস করা। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক আগেই রোগ চিহ্নিত করা যেন কার্যকরভাবে চিকিৎসা দেয়া যায়। এভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষাকে ডায়াগনস্টিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তবে এর মাধ্যমে একদল মানুষকে চিহ্নিত করা যায় যাদের শরীরে কোনো রোগ আছে কিনা বোঝার জন্য আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। স্ক্রিনিং পরীক্ষার ধরন বদলে যেতে পারে বয়স বাড়লে। এটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মেডিকেল ইতিহাসের ওপরও নির্ভরশীল। আর যদি আপনার নির্দিষ্ট কিছু রোগের ঝুঁকি থাকে তাহলেও বদলাতে পারে ধরন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেশির ভাগ তরুণের নিয়মিত কোলনস্কোপি করার দরকার নেই। কিন্তু যদি পরিবারে কারো পলিপ বা কোলন ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে তাহলে ডাক্তার এ পরীক্ষাকে তার নিয়মিত পরীক্ষার অংশ করে দিতে পারেন।
পারিবারিক কোনো ইতিহাস থাকলে জেনেটিক টেস্টিং করতে হতে পারে, যা দিয়ে বোঝা যায় আপনার এসব রোগ তৈরির কোনো উচ্চমাত্রার ঝুঁকি আছে কিনা। এছাড়া কিছু রুটিন স্ক্রিনিং করা জরুরি, যেমন পুরুষের প্রস্টেট ক্যান্সার আছে কিনা জানার জন্য পিএসএ স্ক্রিনিং আর নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ম্যামোগ্রাম। তাই আপনার কোন টেস্টটি দরকার জানার জন্য কথা বলতে হবে ডাক্তারের সঙ্গেই।
ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিফ মেডিকেল অফিসার ড. রিয়াদ নাসের চৌধুরীর মতে, এভাবে স্ক্রিনিংয়ের পরামর্শ সাধারণত প্রতিরোধ করার জন্য দেয়া হয়। কোনো রোগ হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের প্রতিকারের দিকে যেতে হয়। কিন্তু যদি আমরা আগেই রোগটা চিহ্নিত করতে পারি তাহলে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কার কোন পরীক্ষা করা দরকার সে বিষয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মানুষ কিছু অসংক্রামক আর কিছু সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। যদি কোনো চাকরিজীবী আমাদের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আসেন তাহলে তাদের শরীরে সংক্রামক রোগ আছে কিনা আমরা তা বেশি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। যেমন হয়তো কেউ কোনো গার্মেন্টসে বা অফিসে কাজ করে। তাদের কোনো সংক্রামক রোগ থাকলে অন্যরাও আক্রান্ত হতে পারে। সেজন্য আমরা কিছু টেস্ট করে ফেলি যেমন হেপাটাইটিস, লাংসের কিছু রোগ যেমন টিবি ইত্যাদি। আর যারা সাধারণভাবে আসে তাদের অসংক্রামক রোগ যেমন হার্টের সমস্যা, কার্ডিয়াক সমস্যা বা ক্রনিক লিভার ডিজিজ আছে কিনা সেগুলো চিহ্নিত করি।’
সেজন্য কিছু স্ক্রিনিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় কিছু ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন করা হয় আর কিছু বায়োমেডিকেল টেস্ট করা হয়। ড. রিয়াদ নাসের চৌধুরী বলেন, ‘বায়োমেডিকেল টেস্টে কিছু অর্গানে এসব কমিউনিকেবল বা ননকমিউনিকেবল ডিজিজ বেশি হয় সেগুলো টেস্ট করি। যেমন লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিস পরীক্ষা করি। আর ফিজিক্যাল এক্সামিনেশনের মধ্যে থাকে উচ্চতা, ওজন, বিএমআই এসব। এসব কিছুই প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরে প্রয়োজন পড়লে বাড়তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।’
তবে সবার পক্ষে সব পরীক্ষা করা কঠিন। তাতে খরচও হবে অনেকখানি, আবার সময়সাপেক্ষও। সেজন্য কার কোন টেস্ট জরুরি সেটা আলাদা করতে হবে। রিয়াদ নাসের চৌধুরীর মতে, কার কোন টেস্ট করা দরকার সেটা আমরা আলাদা করি লিঙ্গভেদে। নারীদের কোন ক্যান্সার বেশি হয় আর পুরুষের কোন রোগ বেশি হয় সেটা বিবেচনা করে আমরা স্ক্রিনিং করি। আর কিছুক্ষেত্রে ভাগ করি বয়সভিত্তিক। যারা বয়স্ক তাদের কার্ডিয়াক টেস্ট করি, ব্রেইনের কিছু পরীক্ষাও করা হয়। কম বয়সে এসব কম করা হয়।
বিভিন্ন হাসপাতালেই এখন হেলথ স্ক্রিনিং প্যাকেজ থাকে। চাইলে যে কেউ সেটা নিতে পারেন ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই। আবার যদি চান তাহলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করেও নিতে পারেন। তিনিও আপনাকে পরামর্শ দিতে পারবেন কোন পরীক্ষা আপনার করা জরুরি।