থ্রম্বোসিস

থ্রম্বোসিস গুরুতর রোগ হলেও প্রতিরোধযোগ্য

ডা. মো. মনিরুল ইসলাম

ছবি : বণিক বার্তা

থ্রম্বোসিস এমন একটি রক্ত রোগ, যেখানে রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধে এবং রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এটি শিরা (ভেনাস থ্রম্বোসিস) বা ধমনিতে (আর্টারিয়াল থ্রম্বোসিস) ঘটতে পারে। থ্রম্বোসিস হৃদরোগ, স্ট্রোক পালমোনারি অ্যাম্বলিজমের মতো গুরুতর রোগ বা স্বাস্থ্য জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। থ্রম্বোসিস সম্পর্কে জনসচেতনতা, প্রাথমিক শনাক্তকরণ, কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এটি উল্লেখযোগ্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষত শহুরে জনসংখ্যার মধ্যে। এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করছে এবং এর প্রতিরোধ চিকিৎসা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে থ্রম্বোসিসের হার বাড়ছে, বিশেষত যাদের জীবনযাত্রা স্থবির এবং যারা দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন তাদের মধ্যে। এছাড়া অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অসচেতনতা এবং সীমিত স্বাস্থ্য শিক্ষা সমস্যার প্রকোপ বাড়িয়ে তুলেছে।

পরিসংখ্যান: থ্রম্বোসিস একটি অন্যতম বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা। ওয়ার্ল্ড থ্রম্বোসিস ডে ক্যাম্পেইন অনুযায়ী, ভেনাস থ্রম্বোঅ্যাম্বলিজম (ভিটিই) (যার মধ্যে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (ডিভিটি) পালমোনারি অ্যাম্বলিজম (পিই) অন্তর্ভুক্ত) প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী এক কোটি মানুষকে প্রভাবিত করে। যুক্তরাষ্ট্রে রোগে প্রতি বছর প্রায় নয় লাখ মানুষকে আক্রান্ত করে, যার ফলে প্রায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।

কারণ: থ্রম্বোসিস ঘটে যখন শরীরের ক্লটিং প্রক্রিয়ায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় অর্থাৎ তরল রক্ত যখন জমাট বাঁধে। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, রক্তনালিতে আঘাতআঘাত বা অস্ত্রোপচার রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা জমাট বাঁধতে পারে, অনড়তাদীর্ঘ সময়ের জন্য নিষ্ক্রিয়তা, যেমন সড়ক বা বিমানপথে দীর্ঘ যাত্রা অথবা দীর্ঘ সময় বিছানায় বিশ্রাম, রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায়, চিকিৎসাগত অবস্থাক্যান্সার, হৃদরোগ প্রদাহজনিত রোগগুলো থ্রম্বোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়, ওষুধহরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলগুলো জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ঝুঁকির কারণ: কিছু কারণ থ্রম্বোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছেবয়সবয়স বৃদ্ধির সঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ে, স্থূলতাঅতিরিক্ত ওজন শিরায় চাপ বাড়ায় এবং জমাট বাঁধতে পারে, ধূমপানরক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায়, পারিবারিক ইতিহাসহার্ট অ্যাটাক ব্রেন স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, গর্ভাবস্থাপেলভিক শিরায় চাপ বাড়ে এবং রক্তের পরিবর্তন ঘটে।

উপসর্গ

থ্রম্বোসিসের উপসর্গ জমাট বাঁধার স্থানের ওপর নির্ভর করে

  • ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (ডিভিটি): আক্রান্ত অঙ্গে ফোলা, ব্যথা কোমলতা বা নরম হয়ে যেতে পারে। আক্রান্ত স্থানের ত্বক উষ্ণ অনুভূত হতে পারে এবং লাল দেখাতে পারে।
  • পালমোনারি অ্যাম্বলিজম (পিই): হঠাৎ শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, দ্রুত হৃৎস্পন্দন রক্তক্ষরণ।
  • আর্টারিয়াল থ্রম্বোসিস: আক্রান্ত স্থানে তীব্র ব্যথা, পক্ষাঘাত বা অসাড়তা অনুভব করা।

পরিণতি

যদি চিকিৎসা করা না হয় থ্রম্বোসিস গুরুতর জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে

  •  পালমোনারি অ্যাম্বলিজম: অত্যন্ত জটিল ও জীবন হুমকির অবস্থা তৈরি হয়, যেখানে জমাট রক্ত ফুসফুসে চলে যায়।
  • হার্ট অ্যাটাক: করোনারি ধমনিতে জমাট বাঁধা রক্ত স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
  • স্ট্রোক: মস্তিষ্কে রক্ত জমে স্ট্রোক সৃষ্টি করতে পারে, যা পক্ষাঘাত এবং অন্যান্য স্নায়বিক প্রতিবন্ধকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
  • পোস্ট-থ্রম্বোটিক সিনড্রোম: ক্রনিক ব্যথা, ফোলা প্রভাবিত অঙ্গে ত্বকের পরিবর্তন।

প্রতিরোধ

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থ্রম্বোসিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে

  •  নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ: স্বাস্থ্যকর রক্তপ্রবাহ বজায় রাখতে সহায়তা করে।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্য: স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন এবং উচ্চ কোলেস্টেরল থ্রম্বোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • পর্যাপ্ত পানি পান করুন: পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন রক্তকে ঘন করতে পারে এবং জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায়।
  • দীর্ঘ অনড়তা এড়ানো: দীর্ঘ ভ্রমণ বা ডেস্ক কাজের সময় বিরতি নিন।
  • ওষুধ: উচ্চ ঝুঁকির ব্যক্তিদের জন্য অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট (রক্ত পাতলা) ওষুধ দেয়া যেতে পারে।

সচেতনতা তৈরির কৌশল 

থ্রম্বোসিস সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— 

  •  শিক্ষামূলক ক্যাম্পেইন: মিডিয়া প্লাটফর্ম ব্যবহার করে থ্রম্বোসিসের উপসর্গ ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ সম্পর্কে তথ্য ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। 
  •  স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর প্রশিক্ষণ: স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসকদের থ্রম্বোসিসের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার আয়োজন করা যেতে পারে । 
  •  সামাজিক প্রোগ্রাম: স্বাস্থ্য মেলা, কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে। 
  •  রোগীর সহায়তা গোষ্ঠী: ঝুঁকিতে থাকা বা থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সহায়তা ও সংস্থানের জন্য সোসাইটি গঠন করা যেতে পারে। 
  •  ওয়ার্ল্ড থ্রম্বোসিস ডে: এ দিবসে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা ছড়াতে বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। 

থ্রম্বোসিস একটি গুরুতর কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এর কারণগুলো বোঝা, উপসর্গগুলো চিনতে পারা এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে আমরা থ্রম্বোসিসের ঘটনা ও জটিলতা কমাতে পারি। সুস্থ জীবনযাপন চর্চা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, থ্রম্বোসিসের দ্রুত শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা এ লক্ষ্যগুলো অর্জনের চাবিকাঠি। 

বাংলাদেশে থ্রম্বোসিসের বিস্তার রোধ ও কার্যকর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রচেষ্টায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা অতি প্রয়োজনীয়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

সূত্র: হেমাটোলজি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন