খাদ্যনালির ক্যান্সার

প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে খাদ্যনালির ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন

ছবি : বণিক বার্তা

খাদ্যনালি ক্যান্সার, খাদ্যনালির একটি আক্রমণাত্মক ধরনের ক্যান্সার (গলা ও পাকস্থলীর সংযোগকারী দীর্ঘ টিউব)। সারা বিশ্বে মৃত্যুর ষষ্ঠতম সাধারণ কারণ হয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে খাদ্যনালির ক্যান্সারে। বলা হচ্ছে, মোট রোগীর প্রায় ১৪ শতাংশ এ ক্যান্সারে ভোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরে ২১ হাজার ৭৪৫ জনের মধ্যে খাদ্যনালির ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার এবং নারী আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে সাত হাজারের কিছু বেশি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে এ ক্যান্সারের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার রিসার্চ ফান্ডের ২০১৮ সালের গবেষণা অনুযায়ী, খাদ্যনালি ক্যান্সারে আক্রান্তের হারে বাংলাদেশ এশিয়ায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।

খাদ্যনালি ক্যান্সারের সঠিক কারণ অজানা। এটি ডিএনএ মিউটেশন পরিবর্তনের কারণে হতে পারে, যার ফলে এর কোষগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ঘটে। খাদ্যনালির ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে খাদ্যনালির প্রাচীরের আস্তরণে উদ্ভূত হয় এবং টিউবের দৈর্ঘ্য বরাবর যেকোনো স্থানে ঘটে। এ ক্যান্সারের ঘটনা ভৌগোলিকভাবে পরিবর্তিত হয়। খাদ্যনালি ক্যান্সারের দুই প্রকারের মধ্যে একটি হলো অ্যাডেনোকার্সিনোমা ও অন্যটি স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা।

খাদ্যনালির ক্যান্সার হতে পারে এমন ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থূলতা, অ্যালকোহল সেবন, তামাক ব্যবহার, কম ফাইবারযুক্ত খাবার ইত্যাদি। এর পেছনে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার বড় ধরনের সংযোগ আছে। এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে প্রধান কয়েকটি কারণ:

  •  কৃত্রিম রঙ ও প্রিজারভেটিভযুক্ত ভেজাল খাবার খাওয়া।
  •  সব ঋতুতে সবসময় গরম পানি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে।
  •  অতিরিক্ত ফাস্টফুড, আধা-সেদ্ধ খাবার, পোড়া তেলে ভাজা খাবার খেলে।
  •  পান, জর্দা, গুল, সিগারেট, বিড়ি এবং অতিরিক্ত মদপান করলে।
  •  স্থূলতা।
  •  সাধারণত ৪০ বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে ৭৫ বছর বয়সের পর ঝুঁকি কমে যায়।

খাদ্যনালি ক্যান্সার সূচনায় উপসর্গহীন থেকে যায়। এটি অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ লক্ষণগুলো দেখা দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এটি নিরাময়যোগ্য। তবে নিরাময়ের হার কম। এটির নিরাময়যোগ্যতা নির্ভর করে ক্যান্সারটি যে পর্যায়ে শনাক্ত করা হয়েছিল এবং কত তাড়াতাড়ি এটি শনাক্ত করা হয়েছিল তার ওপর। 

খাদ্যনালি ক্যান্সারের চিকিৎসার ধরন ক্যান্সারের পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে। শল্যচিকিৎসা করা যেতে পারে যদি ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা যায়। অর্থাৎ এটি অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার আগে। ক্যান্সার কোষ কমাতে অস্ত্রোপচারের আগে বা পরে কেমোথেরাপি (রাসায়নিকের ব্যবহার) দেয়া হয়। রেডিওথেরাপি (উচ্চ শক্তির বিকিরণ ব্যবহার) কেমোথেরাপির সঙ্গে উন্নত লক্ষণগুলো প্রতিরোধ করার জন্যও ব্যবহার করা হয়।

খাদ্যনালি ক্যান্সার বিভিন্ন উপায়ে প্রতিরোধ করা যেতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে: কম অ্যালকোহল পান, ধূমপান এড়িয়ে চলা, কেউ যদি গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রোগে ভোগে এবং ঘন ঘন বুক জ্বালা হয় তবে একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা, একটি স্বাস্থ্যকর শরীরের ওজন বজায় রাখা, নিয়মিত ফল ও সবজি খাওয়া, শারীরিক কার্যকলাপ।

অ্যাসিড রিফ্লাক্স ডিজিজ থেকে খাদ্যনালি ক্যান্সার 

গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) খাদ্যনালি ক্যান্সার হতে পারে। যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে এটি একটি গুরুতর অবস্থায় পরিণত হতে পারে, যা খাদ্যনালির অভ্যন্তরীণ আস্তরণের ক্ষতি করতে পারে। শেষ পর্যন্ত তা খাদ্যনালির ক্যান্সারের দিকে পরিচালিত করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে জিইআরডি আক্রান্ত রোগীদের অবশ্যই ডাক্তারকে এ সম্পর্কে জানাতে হবে। এ চিকিৎসা বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ হলেও বাংলাদেশে এ চিকিৎসা দেয়ার যথেষ্ট সক্ষমতা আছে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্তের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যদি ক্যান্সার খাদ্যনালি ছাড়াও পাকস্থলী, অন্ত্র বা অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে রোগীর জীবন সংকটে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

লেখক: সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কোঅর্ডিনেটর, স্কয়ার হাসপাতাল ক্যান্সার সেন্টার এবং সাবেক চেয়ারম্যান, অনকোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন