হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসেই বাড়ছে লিভার ফেইলিউর

ডা. সেলিমুর রহমান

ছবি : বণিক বার্তা

লিভার এমন একটি আবশ্যিক প্রত্যঙ্গ, যা পরিপাক নালি থেকে আসা রক্তকে শোধিত করে পুরো শরীরে ছড়িয়ে দেয়। হজমে সাহায্য করা, পেশি গড়ে তোলা, সংক্রমণ রোধ, গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ও রক্ত জমাট বাঁধতে না দেয়া থেকে শুরু করে শরীরে লিভারের বেশকিছু কাজ রয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় রাসায়নিককে বিষমুক্ত করা ও সেবনকৃত ওষুধ কার্যকর করার পাশাপাশি প্রোটিনকে সমন্বয় করে এ লিভার। মানবদেহের এসব কাজ করতে যখন ব্যর্থ হয় তখনই তাকে লিভার ফেইলিউর বলা হয়।

লিভার ফেইলিউরের ভয়াবহতা ব্যাপক। উন্নত বিশ্বে তীব্র লিভার ফেইলিউরের রোগীদের আধুনিক চিকিৎসা পর্যাপ্ত রয়েছে। লিভার প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এটি ভালো করা যায়। তবে সব রোগীকেই প্রতিস্থাপন করতে হয় না। কোন রোগীর প্রয়োজনে এটির জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। মডেল ফর এন্ড-স্টেজ লিভার ডিজিজ (এমইএলডি) স্কোরের মাধ্যমে বেশকিছু তথ্য জানা যায়। এমইএলডি স্কোরের মাধ্যমে রোগীর বেঁচে থাকার পূর্বাভাস বোঝা যায়। তাছাড়া চিকিৎসার ঝুঁকি, সুবিধাগুলোও অনুমান করার জন্য লিভারের রোগের তীব্রতা মূল্যায়ন করতে সহায়তা করে। এটি লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য অঙ্গ বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় এবং যত্নের লক্ষ্যগুলোকে নির্দেশিত করতে সহায়তা করে।

বিভিন্ন কারণে লিভার ফেইলিউর হতে পারে। যেমন তীব্র লিভার ফেইলিউর, দীর্ঘস্থায়ী লিভার ফেইলিউর এবং তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ীর মধ্যবর্তী স্থান। যেসব ব্যক্তির সাধারণত আগে থেকে লিভারের রোগ ছিল না তাদের লিভারের লক্ষণ শুরু হওয়ার চার সপ্তাহের মধ্যে লিভার ফেইলিউর দেখা দেয়। মস্তিষ্ক জড়িত হয়ে প্রথমে আচরণগত পরিবর্তন হয়। এর মাধ্যমে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে যারে। তবে পুরোপুরি অজ্ঞান হয় না। 

আমাদের দেশে লিভার ফেইলিউরের রোগী বাড়ে মূলত হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের কারণে। কিন্তু উন্নত বিশ্বে এসব কারণে হয় না। তারা ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। তাদের বেশি হয় অ্যালকোহলের কারণে। তবে আমাদের দেশে ‘বি’ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের পথে। তাছাড়া জন্ডিসের জন্য গ্রামীণ এলাকায় এখনো কিছু কুসংস্কার রয়েছে। ‘বি’ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এটি একটি বাধা। দেশে ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমে এসেছে। 

হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্তরা বেশি লিভার ফেইলিউরে আক্রান্ত হচ্ছে। যেমন ‘এ’ ভাইরাসের মধ্যে আক্রান্তের হার ১ ভাগ, ‘বি’ ভাইরাসের মধ্যে ৫ ভাগ। এছাড়া ‘ই’ ভাইরাসে আক্রান্তরা লিভার ফেইলিউরে তেমন আক্রান্ত হয় না। তবে যেসব গর্ভবতী নারী ‘ই’ ভাইরাসে আক্রান্ত হন তাদের লিভার ফেইলিউর হওয়ার সম্ভাবনা ২০-২৫ ভাগ। বিশ্বে লিভার ফেইলিউরে মৃত্যুহার প্রায় ৭০ ভাগ। বাকি ৩০ ভাগ রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগেরই লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশে লিভার ফেইলিউরের রোগীর সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি মৃত্যুর হারও বেশি। দেশে তীব্র লিভার ফেইলিউরের চিকিৎসায় প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা সেভাবে শুরু হয়নি। এ চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় মৃত্যু হচ্ছে বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের দেখা যায়, ১৫-২০ ভাগ রোগী লিভারের কোনো না কোনো সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। দেশে ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর হার প্রায় ৬ ভাগ। আর ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হার ১ ভাগ। অনেকে অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ সেবনের কারণে লিভারের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে আশার দিক হচ্ছে বিগত ১০ বছর আগের তুলনায় লিভার রোগীর সংখ্যা কমে এসেছে। ২০১০ সালের আগে দেশে ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্তের হার ছিল ১০ শতাংশের বেশি। এটি বর্তমানে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি কমে আসার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই, আধুনিক চিকিৎসা ও মানুষের সচেতনতা। দেশে এখন শিশুদের হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকা শতভাগ দেয়া হচ্ছে। গ্রামের অনেক মানুষ এখনো জন্ডিস হলে ঝাড়-ফুঁক করাচ্ছে। এতে সঠিক চিকিৎসা পেতে তাদের অনেক দেরি হয়ে যায়। এ সময়ে রোগটি আরো গভীরে চলে যায়। এটি সমাধানে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে পরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা ও প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এ চিকিৎসায় ওষুধের সহজলভ্যতা বাড়াতে হবে। একসময় ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু হতো বেশি। তাছাড়া এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুলও ছিল। বেসরকারি পর্যায়ে এটির চিকিৎসা প্রায় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হতো রোগীদের। সরকার যখন এর জেনেরিক প্রডাক্টে ট্যাক্স তুলে দেয় তখন সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা ব্যয় একেবারেই কমে আসে। বর্তমানে এ চিকিৎসায় ব্যয় হয় ৮০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকার মতো। পাঁচ-ছয় বছর ধরে রোগীরা এ সুবিধা পাচ্ছে।

দেশে লিভারের সব ধরনের চিকিৎসাই পর্যাপ্ত রয়েছে। তবে প্রতিস্থাপন ব্যবস্থায় সংকট রয়েছে। দেশে কয়েকটি প্রতিস্থাপন হলেও বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে। এখনো সেভাবে শুরু হয়নি এ আধুনিক ও স্থায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থাটি। তবে প্রতিস্থাপন-পরবর্তী কিছু জটিলতা দেখা দেয় রোগীদের মধ্যে। এসব জটিলতা দূর করতেও উন্নত চিকিৎসা রয়েছে দেশে। সংকট সমাধানে এরই মধ্যে সরকার বিএসএমএমইউ, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল ও বারডেম হাসপাতালে প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এ কাজ সরকারি হাসপাতালগুলোয় ব্যাপক আকারে শুরু হলে রোগীদের কষ্ট দূর হয়ে যাবে। 

লিভার ফেইলিউর রোগ প্রতিরোধ ও নির্মূলে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ‘বি’ ভাইরাস যেহেতু আমাদের দেশে লিভার ফেইলিউরের বড় কারণ, তাই ‘বি’ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। এখন শুধু শিশুদের এ ভাইরাসের টিকা দেয়া হচ্ছে। এটি সব বয়সী লোকদের মধ্যে দিতে হবে। ব্যবহৃত সুইয়ের ব্যবহার একেবারে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কান বা নাক ফোঁড়ানোর ক্ষেত্রে পুরনো পদ্ধতি অর্থাৎ অপরিচ্ছন্নভাবে না করে আধুনিকভাবে করতে হবে। এন্ডোস্কপি, কোলনোস্কপি ও দাঁতের চিকিৎসাসহ এ ধরনের ক্ষেত্রে জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে। চিকিৎসাকে আরো সহজলভ্য করতে হবে। এছাড়া হেপাটাইটিসের সংক্রমণ ছড়ায় এমন সব ধরনের উৎস নির্মূল করতে হবে। এসব কিছু করলে আশা করা যায় লিভার ফেইলিউরে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। 


লেখক: প্রাক্তন অধ্যাপক, হেপাটোলজি বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন