নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

করাতে পারেন যেসব স্বাস্থ্য পরীক্ষা

ডা. সিদ্ধার্থ দেব মজুমদার

বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। ফলে শরীরে আসন গেড়ে বসে নানা রকম রোগব্যাধি। সময়মতো সঠিক চিকিৎসার অভাবে কিছু সাধারণ সমস্যাই হতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। তাতে হয়রানি, অর্থের অপচয় তো হয়ই, অনেক সময় মৃত্যুঝুঁকিতেও পড়ে প্রিয় মানুষটি। সময়মতো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব রোগের রাশ টেনে ধরা সম্ভব। জেনে নিন নিয়মিত কোন কোন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো আবশ্যক

রক্তচাপ পরীক্ষা: গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি তিনজনে একজন উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনে আক্রান্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি এটি বুঝতে পারেন না। ১৪০/৯০ মার্কারি বা এর বেশি রক্তচাপকে উচ্চরক্তচাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৫০ কোটির বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, মদ্যপান, কায়িক পরিশ্রম না করা, শরীরচর্চা না করা, দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ, স্থূলতা, এমনকি বংশগতির কারণেও উচ্চরক্তচাপ হতে পারে। এ কারণেই বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

দাঁতের পরীক্ষা: বয়স বাড়লে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে বাড়তে থাকে দাঁত ও মুখের জটিলতা। খাবার চিবোতে সমস্যা হয়। মাড়ির প্রদাহ বা পেরিওডোন্টাইটিসের প্রবণতা বেড়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, চুন-জর্দা দিয়ে পান খাওয়া, নিয়মিত যত্ন না নেয়া প্রভৃতি কারণে দাঁতে সমস্যা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় মুখে দুর্গন্ধ, দাঁতে ব্যথা, দাঁত নষ্ট হওয়া, পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ওরাল ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বছরে অন্তত দুবার ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া উচিত এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো জরুরি।

ডায়াবেটিস টেস্ট: ডায়াবেটিস খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুও হতে পারে। তাই ৪৫ বছর বয়সের পর প্রতি বছর একবার ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং বা এওয়ানসি পরীক্ষা করা জরুরি। আর যাদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে তাদের নিয়মিত মাত্রা চেক করা প্রয়োজন।

হাড়ের পরীক্ষা: আন্তর্জাতিক অস্টিওপোরোসিস ফাউন্ডেশনের মতে, পুরুষদের তুলনায় নারীদের অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে ৬৫ বছরের পর নারী-পুরুষ প্রত্যেকেরই নিয়মিত হাড়ের পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।

থাইরয়েড ও হরমোন পরীক্ষা: থাইরয়েডে সমস্যার কারণে শরীরের স্বাভাবিক মেটাবলিজম প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়। প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরিও বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। ফলে শরীর অতিরিক্ত মোটা বা চিকন হয়ে যায়, কর্মস্পৃহা লোপ পায় কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা হয়ে থাকে। টিএসএইচ পরীক্ষার মাধ্যমে থাইরয়েড ও হরমোনের যাবতীয় জটিলতা নির্ণয় করা সম্ভব।

ত্বক পরীক্ষা: বাংলাদেশে ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাই নিরাপদ থাকার জন্য প্রতি বছর অন্তত একবার ত্বক ক্যান্সারের ঝুঁকি আছে কিনা সেটি পরীক্ষা করা উচিত।

শ্রবণ পরীক্ষা: বয়স বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক সমস্যা কিংবা সংক্রমণের ফলে শ্রবণশক্তি কমে যায়। তাই প্রতি দুই-তিন বছর অন্তর অডিওগ্রাম পরীক্ষা করা জরুরি।

চোখের পরীক্ষা: আমেরিকান একাডেমি অব অপথালমোলজির তথ্য অনুযায়ী, ৪০ বছর বয়সের পরই মানুষের দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। যদি আগে থেকে চশমা ব্যবহার করেন সেক্ষেত্রে প্রতি বছর একবার এবং যদি না করেন তবে প্রতি দুই বছর অন্তর চোখের পরীক্ষা করা উচিত।

কোলোরেক্টাল ক্যান্সার টেস্ট: ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি ১০ বছরে অন্তত একবার কোলনস্কোপি করা প্রয়োজন। তবে যদি কোলনে কোনো প্রকার পলিপ দেখা যায়, ভবিষ্যতে আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ বোঝা যায় কিংবা পরিবারে কারো কোলন ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশ মোতাবেক মাঝে মাঝেই পরীক্ষা করানো উচিত।

প্রোস্টেট ক্যান্সার স্ক্রিনিং: রক্তে প্রোস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেনের মাত্রা নির্ণয়ের মাধ্যমে কারো প্রোস্টেটের অবস্থা জানা যায়। চিকিৎসকরা সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পর পরীক্ষা করার জন্য বলে থাকেন। তবে পরিবারে প্রোস্টেট ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে ৪০ বছর বয়সের পরই পরীক্ষা করা উচিত।

ম্যামোগ্রাম: ৪৫ থেকে ৫৪, এ বয়সের ভেতর অন্তত একবার এবং এরপর প্রতি দুই বছরে একবার নারীদের স্তন ক্যান্সার আছে কিনা কিংবা ঝুঁকি আছে কিনা জানতে ম্যামোগ্রাম করা যেতে পারে। তবে যদি পরিবারে কারো স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস থেকে থাকে সেক্ষেত্রে প্রতি বছরই পরীক্ষা করা উচিত।

প্যাপ স্মেয়ার: ৬৫ বয়সের পর অধিকাংশ নারীরই নিয়মিত পেলভিক পরীক্ষা ও প্যাপ স্মেয়ার করানো প্রয়োজন। প্যাপ স্মেয়ারের মাধ্যমে সাধারণ জরায়ু ক্যান্সার নির্ণয় করা হয় এবং পেলভিক পরীক্ষার মাধ্যমে শ্রোণিসংক্রান্ত জটিলতা নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

লিপিড প্যানেল: লিপিড প্যানেল টেস্টের মাধ্যমে সাধারণত রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা, এইচডিএল, এলডিএল, ট্রাইগ্লিসারাইডস ইত্যাদির অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। নিয়মিত লিপিড প্যানেল পরীক্ষা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে হৃদরোগসহ অন্যান্য অনেক রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

লেখক: ব্যবস্থাপক

মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স

ল্যাবএইড হাসপাতাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন