দাঁতের যত্ন

মুখ ও দাঁতের যত রোগ

ডা. রুমন বণিক

ছবি: ইউনিসেফ বাংলাদেশ

দাঁত থাকতে নাকি দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না। সেজন্য এর যত্নের দিকেও অনেকের মনোযোগ কম থাকে। কিন্তু কেমন হবে দাঁতবিহীন জীবন? যত্নের অভাবে দাঁতেরও হয় নানা ধরনের রোগ। তাই অতি দরকারি এ জিনিস ঠিকঠাক রাখতে হলে জানা জরুরি এর নানা রোগ সম্পর্কে। 

দাঁতের ক্ষয়রোগ

দাঁতের ক্ষয় সবার কাছে ডেন্টাল ক্যারিজ বা ডেন্টাল ক্যাভিটি নামেও পরিচিত। এটি দাঁতের খুবই সাধারণ সমস্যা। কার্যত প্রত্যেকেই জীবনের কোনো না কোনো সময় দাঁতের ক্ষয় অনুভব করেছে। ব্যাকটেরিয়া যখন দাঁতের পৃষ্ঠে প্লাক নামে একটি প্রলেপ তৈরি করে তখন দাঁতের ক্ষয় সৃষ্টি হয়। খাবারের শর্করা থেকে ব্যাকটেরিয়া অ্যাসিড তৈরি করে। ব্যাকটেরিয়ার তৈরি অ্যাসিডগুলো দাঁতের এনামেল বা বাইরের স্তরকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসব অ্যাসিড যখন এনামেলের নিচে ডেন্টিন স্তরকে নষ্ট করা শুরু করে তখনই দাঁতের ভাঙন দেখা দেয়। এর কারণে দাঁতে ব্যথাও হয়। ফলে গরম, ঠাণ্ডা বা মিষ্টি খাবার খেলেই দাঁতে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। 

দাঁত ক্ষয়ের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে নিশ্বাসের দুর্গন্ধ, দাঁতে কালো বা বাদামি দাগ, মুখে অপ্রীতিকর স্বাদ ইত্যাদি। 

দাঁতের ক্ষয়ের মাত্রা নির্ণয় করে ক্ষয়রোগের চিকিৎসা শুরু হয়। এর ভিত্তিতে দাঁতের ডাক্তাররা কিছু পদক্ষেপ সুপারিশ করেন। এর মধ্যে ফিলিং, ডেন্টাল ক্রাউন বা ক্যানাল করা লাগতে পারে। অনেক সময় দাঁত ফেলে দিতেও হতে পারে। যদিও এরপর বিভিন্নভাবে দাঁত প্রতিস্থাপন করা যায়। প্রতিদিন নিয়মিত দুবার দাঁত ব্রাশিং ও ফ্লসিংয়ের মাধ্যমে দাঁতের ক্ষয় রোধ সম্ভব। এছাড়া ডেন্টিস্টের কাছ থেকে নিয়মিত চেকআপ করা দরকার। 

মাড়ির প্রদাহ 

মাড়ির প্রদাহ হলো মাড়ি বা পেরিওডেন্টাল রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। এটিও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ বা প্লাক তৈরির কারণে হয়। এ প্রদাহের সাধারণ লক্ষণ হলো মাড়ি লাল হওয়া, ফুলে যাওয়া ও সহজেই রক্তপাত হওয়া।  মুখের দুর্গন্ধ ও সংবেদনশীল দাঁতের সমস্যায়ও অনেকে পড়তে পারেন। এতে খাবার চিবানোর সময় ব্যথা হতে পারে। সঠিক নিয়মে দাঁত ব্রাশ না করলে মাড়ির রোগ হতে পারে। আঁকাবাঁকা দাঁতও হতে পারে যাতে করে পরে সঠিকভাবে ব্রাশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া তামাক ব্যবহার, গর্ভাবস্থা এবং ডায়াবেটিস থাকলেও এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ প্রদাহ ব্যথাহীন হতে পারে। 

নিশ্বাসে দুর্গন্ধ

দুর্গন্ধ বা হ্যালিটেসিস দাঁতের অন্যতম সাধারণ সমস্যা। এর ফলে ব্যক্তিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। মুখের দুর্গন্ধ বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে অস্বাস্থ্যকর মুখগহ্বর, ড্রাইমাউথ বা শুষ্ক মুখ, ওষুধ, সংক্রমণ, ক্যান্সার।

বিভিন্ন ধরনের খাবার থেকেও হ্যালিটোসিস হতে পারে। রসুন বা পেঁয়াজের মতো মসলাজাতীয় খাবারও এর জন্য দায়ী। যেহেতু নিশ্বাসের দুর্গন্ধের কারণগুলো অনেক বৈচিত্র্যময় তাই এ সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ডেন্টিস্ট সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করে তা সমাধানের একটি সর্বোত্তম উপযুক্ত উপায় নির্ধারণ করবেন। 

দাঁতের শিরশির/সংবেদনশীল দাঁত

যখন এনামেল ক্ষয় হয়ে যায় এবং ডেন্টিন উন্মুক্ত হয়ে পড়ে তখনই দাঁত ঠাণ্ডা-গরম খাবার এবং পানীয় সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। ডেন্টিনে ডেন্টিনাল টিউব থাকে, যা দাঁতের গভীরে স্নায়ুর দিকে নিয়ে যায়। গরম বা ঠাণ্ডা খাবার টিউব বরাবর স্নায়ুতে ভ্রমণ করতে পারে এবং তীব্র ব্যথা হতে পারে। দাঁতের সংবেদনশীলতা ডেন্টিন অতি সংবেদনশীলতা নামেও পরিচিত। সংবেদনশীলতার কারণগুলো হলো মাড়ির রোগ, শেকড় সংক্রমণ, ফাটা বা ভাঙা দাঁত, এনামেল ক্ষয়, মাড়ির ক্ষয় ইত্যাদি। 

সংবেদনশীল দাঁতের জন্য বিভিন্ন ধরনের টুথপেস্ট ও মাউথওয়াশ রয়েছে। অনেক সময় এ সমস্যায় ফ্লুরাইড ট্রিটমেন্ট, ক্রাউন, গাম সার্জারি বা রুট ক্যানালও করা দরকার হতে পারে। চিকিৎসা প্রণালি রোগের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। 

ফাটা বা ভাঙা দাঁত

অনেকের ফাটা বা ভাঙা দাঁতের সমস্যাও প্রায়ই দেখা যায়। সাধারণত আঘাত লাগা, শক্ত খাবার চিবানো, ঘুমের সময় দাঁতে দাঁত পিষার কারণে এ সমস্যা হতে পারে। দাঁত যেভাবেই ভাঙুক না কেন যত দ্রুত সম্ভব দাঁতের ডাক্তারের দ্বারা এটি পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসা নেয়া উচিত। সমস্যা সমাধানের জন্য দাঁতের রঙের ফিলিং, ডেন্টাল ক্রাউন, অনলে, ইনলে ইত্যাদি করা হয়ে থাকে। 

রুট ইনফেকশন

অনেক সময় দাঁতের গোড়া ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে এবং ফুলে যেতে পারে। দাঁতের গহ্বরে ফাটল বা ফ্রাকচারের কারণে এমনটা ঘটে। শেকড়ের সংক্রমণের ফলে দাঁতের টিস্যু ও স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং অবশেষে ফোঁড়া বা এবসেস তৈরি করতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী এবং ক্রমাগত দাঁতের শেকড়ে সংক্রমণের একটি লক্ষণ হলো এর ফলে চিবানো এবং কামড়ানো উভয়ই বেদনাদায়ক হবে এবং মুখের যে অংশ সংক্রমণের শিকার হয়েছে তা গরম-ঠাণ্ডা খাবার এবং পানীয়র জন্য খুব সংবেদনশীল হবে। কিছু ক্ষেত্রে সংক্রমণের চারপাশের মুখের অংশও ফুলে যায়। রুট ইনফেকশনে রুট ক্যানাল চিকিৎসা করা হয়।

এনামেল ক্ষয়

এনামেল ক্ষয় এমন একটি অবস্থা যা খুব ধীরে ধীরে তৈরি হয় এবং এর ফলে দাঁতগুলোকে বিবর্ণ ও গোলাকার দেখায়। এর কারণ হলো বেশি পরিমাণে চিনিযুক্ত এবং অ্যাসিডিক খাবার যেমন সোডা এবং মিষ্টি দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়া। তাছাড়া দাঁত খুব ঘন ঘন খুব শক্ত এবং বেশি বেশি সময় ব্রাশ করা এনামেল ক্ষয়ের জন্য দায়ী। এনামেল ক্ষয়ের ফলে দাঁতগুলো খুব সংবেদনশীল ও দুর্বল হয়ে ওঠে। যে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়েছে তাদের হারানো এনামেল পুনরুদ্ধার করা যায় না। চিনিযুক্ত ও অ্যাসিডিক খাবারগুলো কমিয়ে এনামেলের ক্ষয় কমানো যেতে পারে। নরম ব্রিসেলসসহ টুথব্রাশ ব্যবহার করাও সাহায্য করে। এছাড়া ডেন্টাল ভিনিয়ার্স দিয়ে দাঁতের চেহারা ঠিকঠাক করা যায়। 

শুকনো মুখ

যে কেউ শুষ্ক মুখের সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত বয়সকালে সবার এ সমস্যা দেখা দেয় না। কিন্তু এটি বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। শুষ্ক মুখের সমস্যায় পড়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো ক্যান্সারের চিকিৎসা, লালাগ্রন্থির রোগ, স্নায়ুর ক্ষতি ও ডায়াবেটিস। এইচআইভি/এইডস এবং কিছু ওষুধের কারণেও শুষ্ক মুখ এবং শুষ্ক গলার সমস্যা দেখা দিতে পারে। সমস্যা সমাধানে সারা দিন অল্প অল্প করে পানি খেতে হবে। আর যেসব পদার্থের কারণে মুখ শুকিয়ে যায় যেমন অ্যালকোহল, তামাক, ক্যাফেইন এবং মিষ্টি, সেগুলো এড়ানো দরকার। 

ঘুমের মধ্যে দাঁত পিষা/ ব্রুকসিজম

ঘুমের মধ্যে দাঁত পিষার সমস্যাকে বলা হয় ব্রুকসিজম। ঘুমানোর সময়ই এটি বেশি ঘটে। অনেক সময় জেগে থাকা অবস্থায়ও এমনটা ঘটতে পারে। এর ফলে দাঁতের ক্ষতি হতে পারে, চোয়ালে ব্যথা হতে পারে, এমনকি মাথাব্যথা এবং কানে ব্যথাও হতে পারে। যখন কোনো ব্যক্তি ঘুমের সমস্যায় থাকে, মানসিক চাপে থাকে বা উদ্বেগের মধ্যে থাকে তখন ব্রুকসিজমের শিকার হন। সেজন্য এর পেছনের কারণটা চিহ্নিত করা গেলে তা ব্রুকসিজম বন্ধ করতে সাহায্য করতে পারে।

এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ডেন্টিস্ট একটি কাস্টম-মেড মাউথগার্ড ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। যা দিয়ে দাঁত পিষার সমস্যা অনেকটাই কমে আসে এবং দাঁত কিছুটা সুরক্ষিত থাকে। কামড়ের সমস্যা সমাধান করতেও সহায়তা করে এসব মাউথগার্ড।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক

ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন