অটিজম

প্রচলিত আছে অনেক ভুল ধারণা

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ খায়রুল আমিন

অটিজম বা অটিস্টিক শব্দ দুটির সঙ্গে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। তবে অটিজম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা খুব কম মানুষেরই আছে। গ্রামাঞ্চলে এখনো অটিস্টিক শিশুদের জিন-ভূতে ধরেছে বলে মনে করা হয়। অটিজম কোনো বংশগত রোগ নয়। এটি শিশুর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশজনিত এক ধরনের সমস্যা। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (এএসডি) বা অটিস্টিক শিশুদের লক্ষণ ও উপসর্গের মাত্রা বিচিত্র। একজনের উপসর্গের সঙ্গে আরেকজনের হুবহু মিল নেই। কেউ সবাক, কেউ বাকশক্তি থাকা সত্ত্বেও কথা বলে না। কারো আচরণ চঞ্চল, আবার কেউ অতিরিক্ত গুটিয়ে থাকা স্বভাবের। অটিজমের লক্ষণগুলো অতি অল্প বয়সেই দৃশ্যমান হতে থাকে। তবে অটিজম নিয়ে নানা বিভ্রান্তিও প্রচলিত রয়েছে

সন্তানের অটিজমের জন্য দায়ী বাবা-মা: অটিজম বংশগত বা বাবা-মায়ের কারণে হয়েছে, এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। অনেকে মনে করেন, বাবা-মায়ের দুর্বল অভিভাবকত্ব অটিজমের জন্য দায়ী। কোনো কোনো বাবা-মা মনে করেন, সন্তানদের সময় কম দেয়ার কারণে এমন হয়েছে। এর কোনোটিই ঠিক নয়। অটিজমের ক্ষেত্রে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ না নেয়া হলে শিশুর উন্নতি পিছিয়ে যায়। তবে সন্তানের জন্ম-পরবর্তী সময়ে দুর্বল অভিভাবকত্ব অটিজমের জন্য দায়ী তা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।  

অটিজম শনাক্ত করতে মেডিকেল পরীক্ষা প্রয়োজন: অনেকেই মনে করেন অটিজম শনাক্ত করতে শিশুর মেডিকেল পরীক্ষা করাতে হবে। যা মোটেও ঠিক নয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অটিজম বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা শিশুর আচরণ মূল্যায়ন করে এটি নিশ্চিত করেন। যেমন অটিস্টিক শিশুরা চোখে চোখ রাখে না, নাম ধরে ডাকলে কোনো প্রতিক্রিয়া করে না, বারবার একই কথা বলতে থাকে ও একই কাজ করতে থাকে, অর্থহীনভাবে দুলতে থাকে এবং আরো নানা উপসর্গ তাদের মধ্যে দেখা দেয়।  

শুধু ছেলে শিশুদেরই অটিজম হয়: কেউ কেউ মনে করেন অটিজম শুধু ছেলে শিশুদেরই হয়। সত্যিটা হলো মেয়েশিশুদেরও অটিজম হতে পারে। যেকোনো জাতি, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বয়সভেদে অটিজম হতে পারে।

অটিজম একটি মানসিক রোগ: অনেকের ধারণা, অটিজম একটি মানসিক রোগ। আসলে এটি মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের মস্তিষ্কের দুই পাশের গঠনে এবং নিউরোট্রান্সমিটার লেভেলে অসংগতি রয়েছে। 

অটিস্টিক মানুষ কখনো আত্মনির্ভরশীল হতে পারে না: অটিজম স্থায়ী কোনো অবস্থা নয়। এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুইভাবেই পরিবর্তিত হতে পারে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আরো প্রকটভাবে এটি দেখা দিতে পারে। এমন শিশুরা বয়ঃসন্ধিকালে বিষণ্নতায় ভুগতে পারে, কোনো কোনো শিশুর এপিলেপ্সিও দেখা দিতে পারে। তবে এর ইতিবাচক পরিবর্তন হতেও দেখা যায় অনেক সময়। সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা করলে এমন শিশুও খুব ভালোভাবে নিজের কাজ নিজে করতে পারে এবং আত্মনির্ভরশীলভাবে বেড়ে উঠতে পারে।

অটিস্টিক শিশুরা কারো সঙ্গে মিশতে পারে না: অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা কারো সঙ্গে মিশতে পারে না, সামাজিক যোগাযোগ করতে পারে না এটি ঠিক নয়। তারা মিশতে চায়, যোগাযোগ করতে চায়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগে প্রায়োগিক দক্ষতার অভাবে তারা সেটি করে উঠতে পারে না। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে তারা বেশ মেধাবী হয়ে থাকে। সাধারণ বুদ্ধি ও চিন্তার দিক থেকেও তারা সক্ষম থাকতে পারে। তাদের বাচনিক ও অবাচনিক যোগাযোগের দক্ষতাও বাড়ানো সম্ভব। বিশেষ নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ পেলে তারাও সামাজিক যোগাযোগ ও কাজকর্মে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। কখনো কখনো বন্ধুত্বও গড়ে তুলতে পারে।

সব অটিস্টিক শিশু এক, এদের বিশেষ খাবার প্রয়োজন হয়: অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রতিটি শিশু ও ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। কেউ কেউ মনে করেন, এমন শিশু ও ব্যক্তির জন্য আলাদা ও বিশেষ ধরনের খাবার প্রয়োজন হয়। অটিজমে আক্রান্ত কারো কারো দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার, গ্লুটেনযুক্ত খাবারে অ্যালার্জি থাকতে পারে। আবার চিনিযুক্ত যেসব খাবারে অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি সেসব খাবারে সমস্যা হতে পারে। তার মানে এই না তারা স্বাভাবিক খাবার খেতে পারে না। 

অটিজম সাময়িক, বয়স বাড়লে ঠিক হয়ে যাবে: অটিজম কখনই পুরোপুরি ঠিক হয় না। তবে যথাযথ সহযোগিতা, সমর্থন, শিক্ষা, সঠিক ও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে এটি কমিয়ে আনা যায়। শিশু পরিণত বয়সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে। তাই বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে, চিকিৎসার প্রয়োজন নেই এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।  

শিশুর দেরিতে কথা বলাই অটিজম: অনেক সময় শিশু দেরিতে কথা বলতে শেখে। এটি অটিজমের একমাত্র লক্ষণ তা নয়। কথার পাশাপাশি নানা অঙ্গভঙ্গি করেও শিশু অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে। হাত নাড়ানো, কাঁধ ঝাঁকানো, হাসি ইত্যাদির মাধ্যমে শিশু অনেক কিছু বোঝাতে পারে। শিশু যদি কথা না বলে কিন্তু সবার সঙ্গে মেশে, ডাকলে সাড়া দেয়, চোখে চোখ রেখে কথা শোনে বা প্রতিক্রিয়া দেখায় তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। 

একই পরিবারে একজনের বেশি কারো অটিজম থাকে না: অটিজমের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। জিনগত সমস্যা অটিজমের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়। তাই একই পরিবারে কয়েকজনের অটিজম হতে পারে। একজনের হলে আর কারো হবে না এটি পুরোপুরি ঠিক নয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে একই পরিবারে একাধিক ভাইবোন ও যমজ সন্তানদের উভয়ের মধ্যে অটিজমের প্রবণতা দেখা গেছে। 

অটিজম থাকলে অন্য কোনো ডিজঅর্ডার থাকে না: অটিজম থাকলে অন্যান্য ডিজঅর্ডার থাকবে না—এটিও একটি ভুল ধারণা। এমন অনেকের মধ্যে বধিরতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, এপিলেপ্সি, অন্ধত্ব, ডাউন সিনড্রোমসহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

নিবিড় ব্যবহারিক পরিচর্যা, স্কুলভিত্তিক প্রশিক্ষণ, সঠিক স্বাস্থ্যসেবা ও সঠিক ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে শিশুর অটিজমের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তাই যথাযথ সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা দূর করে অটিস্টিক শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে হবে। 

লেখক: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ 

প্রাক্তন একাডেমিক ডিরেক্টর

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন