সাক্ষাৎকার

দেশে কোলনস্কোপি বিশেষজ্ঞ ও সুবিধা সীমিত

অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম কিবরিয়া। শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক। গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিষয়ে অধ্যাপনা, গবেষণা, চিকিৎসা ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞতা তার দীর্ঘদিনের। দেশে রোগ নিরীক্ষা পদ্ধতি কোলনস্কোপির পরীক্ষা পদ্ধতি, সুবিধা, সীমাবদ্ধতা ও সাধারণের মধ্যে ধারণা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

কোন ধরনের রোগ শনাক্তের জন্য কোলনস্কোপি গুরুত্বপূর্ণ?

কোলনস্কোপি একটি পরীক্ষা, যেখানের আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে একটি নলের মাথায় লাইট সুইচ ক্যামেরা লাগানো থাকে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের কোলন অর্থাৎ বৃহদন্ত্রের ভেতরের দেয়ালটা সরাসরি দৃষ্টিগোচর করা যায় এবং সেখানে কোনো রোগ থাকলে তা নির্ণয় করা যায়। মানব শরীরে খাদ্যনালি থেকে শুরু করে পায়ুপথ পর্যন্ত - মিটার লম্বা যে হজম অন্ত্র, তার শেষ দেড় মিটার হলো কোলন। ইংরেজি অক্ষর ইউকে উল্টো করলে যে রকম হয়, সেভাবে এটি আমাদের পেটের মধ্যে থাকে। পায়ুপথে কোলনস্কোপি নামক যন্ত্রটি প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করা হয়। সাধারণত পেটের সমস্যা, যেমন মলত্যাগজনিত সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, রক্তস্বল্পতা, পায়ুপথে রক্তক্ষরণ হওয়া, রক্ত আমাশয়, পলিপ, পেটের মধ্যে চাকা, কোলনের টিউমার, অন্ত্রের টিবি রোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোলনস্কোপি করানো হয়। কেবল রোগ নির্ণয় নয়, রোগের চিকিৎসার জন্যও কোলনস্কোপি করানো হয়। অন্ত্রের মধ্যে পলিপ হলে তা যন্ত্রের সাহায্যে অপারেশন ছাড়াই কেটে বের করে ফেলা যায়। অনেক সময় কোলন ক্যান্সার, যেগুলো কোলনের দেয়ালের উভয় ভাগে থাকে, কোলনস্কোপির মাধ্যমে তা অপারেশন ছাড়াই সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করা যায়।

বাংলাদেশে চল্লিশোর্ধ্ব মানুষের ক্ষেত্রে কোলনস্কোপি করার প্রয়োজনীয়তা কেমন?

আমাদের এখানে পপুলেশন বেজড ডাটা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। তবে যাদের পরিবারে কোলন ক্যান্সারের ইতিহাস আছে, তাদের মধ্যে চল্লিশোর্ধ্ব যারা আছেন, তাদের কোলনস্কোপি করে ধরনের সমস্যা আছে কিনা, তা যাচাই করা উচিত। আর যাদের পরিবারে এমন ইতিহাস নেই, তাদেরও বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব হলে কোলনস্কোপির মাধ্যমে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি আছে কিনা, তা যাচাই করে নেয়া উচিত। তবে আমাদের দেশে কোলনস্কোপির এক্সপার্ট এর ফ্যাসিলিটি সীমিত। তাই সাধারণত যাদের রোগের লক্ষণ দেখা দেয়, তাদেরই কোলনস্কোপি করানো হয়।

বাংলাদেশে সরকারি দু-একটি হাসপাতালে কোলনস্কোপি হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে তেমন হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী? এর পরিসর কেমন হওয়া উচিত?

ব্যাপারে আমরা সারা বাংলাদেশে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছিলাম। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ৪০০ মেডিকেল সেন্টারে এন্ডোস্কোপি এবং ২০০টি মেডিকেল সেন্টারে কোলনস্কোপি করানোর সুযোগ আছে। সরকারিগুলোর মধ্যে পুরনো আটটি মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম হাসপাতাল শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে কোলনস্কোপির সুযোগ আছে। সেখানে গ্যাস্ট্রোলজিস্টরা কোলনস্কোপি করেন। কোনো কোনো জায়গায় আজকাল সার্জনরাও কোলনস্কোপি করেন। তবে ব্যাপারে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ আছে কিনা, তা নিয়ে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ যদি টেস্ট করেন, তবে পরবর্তী সময়ে আবার রিভিউ টেস্টের প্রয়োজন হয়। এতে বেশ অসুবিধা হয়। রোগ অনেক সময় শনাক্ত হয় না। ফলে অতিরিক্ত টেস্ট করার প্রয়োজন হয়। তাই এটি নিয়ে একটি নীতিমালা প্রয়োজন। কোলনস্কোপির ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ, সুযোগ-সুবিধা, প্রযুক্তি ইত্যাদি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

কোলনস্কোপি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির বিশেষজ্ঞদের স্বল্পতা বা সীমাবদ্ধতা কেমন?

সারা বিশ্বে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য একজন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট থাকা উচিত।  কিন্তু আমাদের দেশের ১৭-১৮ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ১৫০-২০০ জন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট বা হেপাটোলজিস্ট আছেন, যাদের এন্ডোস্কোপি কোলনস্কোপি করার প্রশিক্ষণ আছে। অর্গানাইজড ট্রেনিংয়ের বাইরেও অনেকে পরীক্ষাগুলো করেন। কিছু মেডিসিন স্পেশালিস্ট করেন, কিছু সার্জিক্যাল স্পেশালিস্ট করেন। যে পরিমাণ এন্ডোস্কোপিস্ট কোলনস্কোপিস্ট বাংলাদেশে আছেন, তাদের সংখ্যা অন্তত -১০ গুণ বাড়ানো দরকার।

বাংলাদেশে জনসচেতনতার জায়গায় কোলনস্কোপি এখনো আসেনি। ডাক্তার বললেও পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে অনেকের অনীহা থাকে। সেটা কেন?

আসলে বিশ্বব্যাপী ধরনের পরীক্ষাগুলো কিছুটা ইনভেসিভ। সেটা নিজের ওপর অ্যাপ্লাই করার বিষয়ে মানুষের অনীহা কাজ করে। পরীক্ষার ধরনটাই এমন। বারবার মলত্যাগ করে কোলন পরিচ্ছন্ন করতে হয়। আবার সাধারণত মানুষ নিজের প্রাইভেট পার্টস এক্সপোজ করতে কম চায়। তাই সমস্যা তীব্র হলেই কেবল সবাই এটা গ্রহণ করে। তাছাড়া আমার মনে হয় পরীক্ষার গুরুত্ব উপকারিতা নিয়ে মানুষের ধারণা নেই। সবারই ভাবনা থাকে ওষুধ খেয়েই পরিত্রাণ পাওয়া যায় কিনা। সেজন্য সাধারণ মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা কম। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এর খরচ অনেক কম। সেখানে একজনের কোলনস্কোপি করতে থেকে লাখ টাকা ব্যয় হবে। সেটা বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে দেড় হাজার টাকার মধ্যে সম্ভব। বেসরকারিতে অনেক বেশি খরচ হয়। জেনে অবাক হবেন ইন্স্যুরেন্স করা নেই এমন অনেক প্রবাসী দেশে এসে পরীক্ষা করে যান। তাতে তাদের প্লেন ভাড়া অন্যান্য কাজও একই সঙ্গে হয়ে যায়। তবে একেবারেই যে কেউ করতে চায় না তা নয়, তার পরও মানুষের বোঝাপড়ায় কিছুটা গ্যাপ আছে। সেজন্য পরীক্ষার কথা বললে কিছুটা অনীহা কাজ করে।

মানুষ কি একদম শেষ পর্যায়ে ডাক্তারের কাছে আসছেন নাকি সমস্যা দেখা দিলেই আসছেন?

উন্নত দেশগুলোতে কোলনস্কোপি একটি স্ক্রিনিং টেস্ট হিসেবে প্রচলিত। সেটা আমাদের দেশে এখনো নেই। যাদের কিছু লক্ষণ দেখা দেয় এবং মনে করা হয় যে সেগুলো কোলনের রোগের কারণে হচ্ছে তাদের কোলনস্কোপি করতে বলা হলে একটি অংশ কোলনস্কোপি করতে রাজি হয়। বাকিদের কিছুটা অনীহা কাজ করে। এখানে যাদের ক্যান্সার পাচ্ছি তাদের স্টেজটা অ্যাডভান্সড। বিদেশে সন্দেহ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা স্ক্রিনিং করে, তাই আর্লি স্টেজে তা ধরা পড়ে। আবার শুরুতে যারা চিকিৎসা প্রদান করেন তারাও কোলনস্কোপি করতে দিতে দেরি করেন। আরেকটি কথা বলতে হয়, তিন বছর আগে দেশে যে যন্ত্রগুলো ছিল সেগুলো পুরনো ধাঁচের যন্ত্র ছিল, যেগুলো দিয়ে আর্লি স্টেজে ক্যান্সার জাতীয় রোগগুলো ধরা যেত না। আবার যিনি কোলনস্কোপি করছেন তিনি যদি যথাযথ প্রশিক্ষিত না হন তাহলে আর্লি স্টেজ মিস করতে পারেন। কয়েক বছর পরে আবার টেস্ট করলে তখন অ্যাডভান্সড স্টেজে ধরা পড়ে। আমাদের দেশে রোগীর বয়সেও উন্নত বিশ্বের তুলনায় ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে বয়স ৪০-এর পর রোগ বেশি দেখা যায়, আমাদের দেশে তরুণদের মধ্যেও রোগের প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি।                                                     

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন