সাক্ষাৎকার

বিশেষায়িত চিকিৎসার সবই রাজধানীকেন্দ্রিক

অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন এ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ প্রতিরোধ, চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ। সম্পর্কে জনগণ কতটা সচেতন?

প্রথমত, জানিয়ে রাখি, সারা বিশ্বে এটি এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি। মোটামুটিভাবে প্রতি তিনজনের একজনের মৃত্যুর কারণ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ। বাংলাদেশেও এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রোগে মৃত্যুবরণ করে। তবে আমাদের দেশে বিষয়ে সচেতনতা একেবারে হয়নি এটা বলা যাবে না। যেমন ধূমপানের বিষয়ে অনেকটাই সচেতন করা গেছে যে এটি হৃদরোগের একটি বড় কারণ। বাতজ্বরসংক্রান্ত চিকিৎসায় বাংলাদেশে একটি নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আজ থেকে ২০ বা ৩০ বছর আগে প্রচুর রোগী আসত যাদের ভালভ নষ্ট হয়ে যেত রিউমেটিক ফিভার বা বাতজ্বরের কারণে। ঢাকায় বাতজ্বর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরই রোগে আক্রান্তের হার অনেকটা কমে এসেছে। আবার কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সচেতনতা এলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। সুতরাং বলতে পারি, বিষয়ে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেখানে অনেক বিষয়ে সচেতনতা গড়ে উঠেছে, অনেক বিষয়ে হয়নি। বিশেষ করে আমি বলতে চাই, আমাদের খাদ্যাভ্যাস খুব খারাপ হয়ে গেছে। শহরের শিশুদের জন্য খেলাধুলার সুযোগ খুব সীমিত হয়ে আসছে। তারা মাঠে খেলার পরিবর্তে মোবাইলে গেম খেলতে পছন্দ করে। এতে তাদের ওপর দীর্ঘমেয়াদে যে একটা ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে তা নিয়ে আমাদের সচেতনতা ততটা তৈরি হয়নি।

মানুষের ধারণা, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ মৃত্যুর কারণ। আসলে রোগে আক্রান্তরা আপনাদের কাছে কোন পর্যায়ে আসছে?

গত কয়েক দশকে এর চিকিৎসা ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। মেডিকেল সায়েন্সের অন্য অনেক বিষয়েই এতটা উন্নতি হয়নি। ১৫ বা ২০ বছর আগেও বাংলাদেশের বাইপাস অপারেশন সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। এটা শুধু বাংলাদেশে না সারা বিশ্বেই হয়েছে, কারণ প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অনেক বেশি হয়েছে। যদি কারো কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, হার্টে ব্লক আমরা সময়মতো নির্ণয় করতে পারি, তাহলে তার সুচিকিৎসা ভালো থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। মানুষের মধ্যে এখন সচেতনতাও অনেক হয়েছে, যেমন বুকে ব্যথা হলেই চিকিৎসা বা পরামর্শ নেয়া দরকার, কেউ সিঁড়িতে উঠতে গেলেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে তাহলেও পরামর্শ নেয়া দরকার। এসব ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে। তবে দেশে চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ-সুবিধাও যথেষ্ট পরিমাণে সৃষ্টি করতে হবে। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা মূলত বড় বড় শহরেই হচ্ছে। চিকিৎসার সুবিধা যদি আমরা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে না পারি তাহলে একটি বড় জনগোষ্ঠী চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরে থেকে যাবে।

৫৩ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দেরিতে আসার কারণে মৃত্যুর মুখে পড়ছে। বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানাবেন।

হৃদরোগ যখন মানুষের হয় তখন দুই ধরনের প্রেজেন্টেশন হয়। একটাকে বলি ক্রনিক প্রেজেন্টেশন, যেখানে ধীরে ধীরে রোগী বুঝতে পারেন, কিন্তু ব্যথা এতটা না যে প্রথমেই আপনাকে হাসপাতালে যেতে হবে। আর একটা হচ্ছে হঠাৎ করে এত বেশি যে আপনাকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। ক্রনিক হলে কিছুটা সময় পাওয়া যায়, কিন্তু হঠাৎ হলে দ্রুত চিকিৎসা দিতে হবে।

জেলা হাসপাতালগুলোতে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের  ন্যূনতম চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কী ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে?

প্রথমত, আমাদের সদিচ্ছার অভাব আছে। আমরা সবকিছু একটা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছি। এক্ষেত্রে সবারই দায়বদ্ধতা আছে। আমার পরামর্শ হলো, জেলা পর্যায়ে পুরনো যে আটটা মেডিকেল কলেজ আছে অন্তত সেখানে যদি আমরা ভালো হৃদরোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি। যেখানে হার্টের অপারেশন হবে, ভালো একটা সিসিইউ থাকবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সেখানে পদায়ন করতে হবে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পদ সৃষ্টিতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। দ্বিতীয়ত, যন্ত্রপাতিরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সীমিত পরিমাণ অর্থেই কিন্তু ব্যবস্থাটুকু করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য যে সুষ্ঠু পরিকল্পনা সদিচ্ছা দরকার, সেক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে।

কোন কোন রোগ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজকে প্রভাবিত করে?

এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো উচ্চরক্তচাপ ডায়াবেটিস। এর বাইরে ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস জীবনযাপনও হৃদরোগের বড় কারণ। যদি আমরা রেডমিট চর্বিযুক্ত খাবার বেশি গ্রহণ করি, শাকসবজি কম খাই, কায়িক পরিশ্রম কম করি, তাহলে আমাদের হৃদরোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এছাড়া আমরা যদি খুবই স্ট্রেসের মধ্যে থাকি, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিই, না ঘুমাই তাহলেও আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

হৃদরোগের চিকিৎসা কতটা দীর্ঘমেয়াদি এবং এর ব্যয় কেমন?

হৃদরোগের চিকিৎসা আসলে দীর্ঘমেয়াদি। ইনফেকশনজনিত রোগ ছাড়া যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে আজীবন চিকিৎসা নিতে হয়। হৃদরোগের চিকিৎসায় খরচ হয়, তবে অন্যান্য অনেক চিকিৎসার তুলনায় কম। কিন্তু এর কার্যকারিতা যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে এর ব্যয়টা খুব বেশি নয়। তার পরও অনেকের জন্যই এর ব্যয়সীমা সাধ্যের বাইরে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন