রক্তে চর্বি: আপনি কি সচেতন

অধ্যাপক ডা. কাজী তারিকুল ইসলাম

ছবি: লালপ্যাথ ল্যাব

চিকিৎসা বা পরামর্শ দেয়ার আগে চিকিৎসকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছু টেস্ট করতে দেন। তার মধ্যে একটি সাধারণ টেস্ট হচ্ছে লিপিড প্রোফাইল। অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে কেন এই টেস্ট করতে হবে? 

লিপিড শব্দের অর্থ চর্বি। লিপিড প্রোফাইল হলো এমন পরীক্ষা যার সাহায্যে রক্তে চার ধরনের চর্বির মাত্রা নির্ণয় করা যায়। শরীরে রক্তের ভেতর লাইপোপ্রোটিন বা লিপিড অস্বাভাবিক মাত্রায় থাকার পরিস্থিতিকে বলা হয় ডিসলাইপিডেমিয়া। এক্ষেত্রে লাইপোপ্রোটিন বা লিপিডের মাত্রা অনেক কম অথবা অনেক বেশি থাকতে পারে। তবে সচরাচর এর বেশি পরিচিত রূপ হলো হাইপারলাইপিডেমিয়া অর্থাৎ লিপিডের উচ্চমাত্রা।

ডিসলাইপিডেমিয়া হলে লিপিড রক্তনালির ভেতর জমা হয়ে এথেরোসক্লেরোসিস করতে পারে অর্থাৎ রক্তনালিকে সরু বানিয়ে ফেলে। এর ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, টিআইএ, পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজ, হাইপারটেনশন বা উচ্চরক্তচাপ, ফ্যাটি লিভারসহ আরো বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের লিপিড বা কোলেস্টেরল থাকলেও মূলত লো ডেনসিটি লিপিড (এলডিএল), হাই ডেনসিটি লিপিড (এইচডিএল) এবং টিজি বা ট্রাইগ্লিসারাইড সর্বাধিক পরিচিত। এলডিএল এথেরোসক্লেরোসিসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে এলডিএলের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় ১০ শতাংশ বাড়লে সেই ব্যক্তির করোনারি হার্ট ডিজিজ হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।

একইভাবে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলেও একই ধরনের সমস্যার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াটাইটিস নামক পেটের এক ধরনের ভয়ংকর অসুখ করতে পারে। তবে এইচডিএল কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের জন্য ভালো, যেটা এথেরোসক্লেরোসিসের বিরুদ্ধে কাজ করে আমাদের বরং উপকারই করে।

হাইপারলাইপিডেমিয়ার জন্য যেসব কারণ অনেক বেশি দায়ী সেগুলো হলো: ১. বংশগত বা পারিবারিক ২. কার্বোহাইড্রেট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট অনেক বেশি পরিমাণে খাওয়া ৩. ওবেসিটি বা শারীরিক স্থূলতা (বিএমআই ৩০-এর বেশি) ৪. ধূমপান, অনেক পরিমাণে অ্যালকোহল গ্রহণ ৫. হরমোনজনিত অসুখ, যেমন ডায়াবেটিস, হাইপোথাইরয়েডিজম ৬. লিভারের অসুখ, যেমন হেপাটাইটিস ৬. কিডনির অসুখ, যেমন ক্রনিক রেনাল ডিজিজ (সিকেডি), নেফরোটিক সিনড্রোম ৭. অনিয়ন্ত্রিতভাবে স্টেরয়েড বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ ইত্যাদি।

ওপরের বিষয়গুলোর কোনো একটি আপনার শরীরে উপস্থিত থাকলে আপনার ডিসলাইপিডেমিয়া আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। বেশির ভাগ মানুষই জানে না যে তারা ডিসলাইপিডেমিয়ায় ভুগছে, কারণ এর তেমন কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ খুব একটা চোখে পড়ে না। সেক্ষেত্রে ফাস্টিং লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করানো হলে রোগটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। তবে এই পরীক্ষার ফলাফল যেন ভুল না আসে সেজন্য কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে। যেমন পরীক্ষা করার জন্য রক্ত দেয়ার আগে কমপক্ষে ১৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হবে (তবে পানি খাওয়া যাবে), পরীক্ষার আগের রাতে কোনো ফ্যাটজাতীয় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে, পরীক্ষার আগের দুই সপ্তাহে ব্যক্তি সচরাচর যে খাবারগুলো খেয়ে থাকেন সেগুলোই খাবেন।

কাঙ্ক্ষিত লিপিড মাত্রাসমূহ : টোটাল কোলেস্টেরলের (টিসি)পরিমাণ: প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ২০০ মিলিগ্রামের নিচে।

এইচডিএল কোলেস্টেরল: প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ৫০ মিলিগ্রামের বেশি।

এলডিএল কোলেস্টেরল: প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ১০০ মিলিগ্রামের নিচে; ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ/স্ট্রোকের রোগীদের জন্য প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ৭০ মিলিগ্রামের নিচে।

ট্রাইগ্লিসারাইড (টিজি): প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ১৫০ মিলিগ্রামের নিচে।

ডিসলাইপিডেমিয়া হলে কী করবেন?

প্রথমত, খুঁজে বের করতে হবে কী কারণে ডিসলাইপিডেমিয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জীবনযাপনের দৈনন্দিন কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। যেমন শরীরের ওজন কমাতে হবে। সপ্তাহে অন্তত তিন-চারদিন ৩০ মিনিট করে জোরে হাঁটা বা ব্যায়াম করতে হবে। ধূমপান পরিহার করতে হবে এবং বাড়তি মাত্রার অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকতে হবে। জাংক ফুড, তেলে ভাজা খাবার, খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত চিনি এড়িয়ে চলতে হবে। ভোজ্যতেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে অধিক ব্যবহৃত সয়াবিন তেলে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ যেটা ডিসলাইপিডেমিয়ার অন্যতম কারণ; অন্যদিকে নারকেল তেল ও অলিভ অয়েলে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ যথাক্রমে মাত্র ২ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ। তাই সম্ভব হলে সয়াবিন তেলের পরিবর্তে এগুলো ব্যবহার করা দরকার। রেড মিট, মাখন, ঘি, চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণ কমিয়ে ফেলতে হবে। মাছ, বাদাম, সবজি, ফলমূল আরো বেশি পরিমাণে খেতে হবে। 

বর্তমানে স্ট্যাটিন, ফাইব্রেট, নিকোটিনিক অ্যাসিড, এজিটিমাইবসহ বেশকিছু ড্রাগ প্রচলিত রয়েছে ডিসলাইপেডেমিয়ার চিকিৎসায়। এই ওষুধগুলো যেমন এথেরোসক্লেরোসিস প্রতিরোধে সাহায্য করে ঠিক তেমনি গবেষণায় দেখা গেছে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের মতো অসুখগুলোতে হাসপাতালে ভর্তির পরিমাণও বেশ কমিয়ে ফেলতে পারে। এসব ওষুধ যেমন সঠিক ডোজে ব্যবহার করা জরুরি ঠিক তেমনি অন্যান্য ওষুধের মতো এরও বেশকিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এজন্য একজন মেডিসিন বা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করা বা মনিটরিং করা অতি জরুরি।

সর্বশেষ কথা হলো ডিসলাইপিডেমিয়া থাকলেই ভয় পাবেন না, বরং এটিকে ওয়ার্নিং হিসেবে গ্রহণ করে দৈনন্দিন চলাফেরা, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করুন ও সঠিক উপায়ে ডাক্তারের দেয়া ওষুধ গ্রহণ করুন। এগুলোর সামগ্রিক প্রভাব আপনাকে একটি স্বাস্থ্যকর ও আনন্দময় জীবনযাপনে দিতে পারে পূর্ণ সহায়তা।

লেখক: অধ্যাপক, মেডিসিন 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন