দুটি সংকট কখনই এক নয়। সম্প্রতি যেসব অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে, যেমন ১৯৯০-এর শেষ দিকে এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট, ২০০০ সালের ডটকম সংকট এবং ২০০৮-০৯ সময়ের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, সেক্ষেত্রে এটা সত্য। ভূ-কৌশলগত ধাক্কা যেমন যুদ্ধ, মড়ক, দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীর কারণে তৈরি হওয়া সংকটের ক্ষেত্রেও এমনই ঘটে।
এখনো আমরা এসব অস্থিরতার দুটি ক্ষেত্রে সম্ভাব্য মারাত্মক ইন্টারপ্লে (যেখানে দুই ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করে) দেখতে পাচ্ছি। তার একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট, যেটা সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ব্যর্থতায় বেশি প্রতিফলিত হয়েছে এবং অন্যটি ভূ-কৌশলগত সংকট, যেটা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে আরো গভীর স্নায়ুযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও সব সংকটের উৎস ভিন্ন, তবে এক অর্থে সেসব ঠিক বিষয় হয়ে ওঠে না। কেননা এ দুইয়ের মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল এ অংশগুলোর সমষ্টি থেকে বেশি হতে পারে।
এসভিবির ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়া অনেক বড় কোনো সমস্যার লক্ষণ। আর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মূল্যস্ফীতির ফিরে আসা এবং মুদ্রানীতি সহসা স্বাভাবিকীকরণের জন্য অপ্রস্তুত ছিল। এসভিবির ঝুঁকি ব্যবস্থাপকরা এ ধরনের কোনো ফলাফলের বিষয়ও তীব্রভাবে অস্বীকার করে আসছিলেন। তাছাড়া ১২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বন্ড পোর্টফোলিওতে বড় ক্ষতির মুখে ব্যাংকটি আরো নিচে নেমে যায়। এর ফলে ক্ল্যাসিক ব্যাংকটি ভয়ভীতিপূর্ণ আমানতকারীদের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার বিষয়টি আরো বেশি প্রভাবিত হয়।
আমেরিকার স্টার্টআপ সংস্কৃতির বড় বড় রথী-মহারথীসহ আমানতকারীদের জটিল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সম্পদ রাখার পর খুব বেশি নিরীক্ষা করছেন না বলে দায়ী করা যাবে না। কারণ এ কাজ ফেডারেল রিজার্ভের, তারা সেটি করেনি। ডটকম থেকে শুরু করে হাউজিং পর্যন্ত ক্রেডিট ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পদের ক্ষেত্রে এবং কভিড-পরবর্তী মূল্যস্ফীতিকে ‘ক্ষণস্থায়ী’ হিসেবে ভুলভাবে ধরে নিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ বেশ বড় ভুল করে। তারা বড় ব্যাংকগুলোর ওপর দৃষ্টি স্থির করে কিন্তু এসভিবি, সিগনেচার ও ফার্স্ট রিপাবলিকের মতো ছোট আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোকে উপেক্ষা করে যায়। আর সেখানেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা।
২০০৮ সালে নতুন নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা প্রয়োগের পর এ ফলাফল খুবই মন ভেঙে দেয়ার মতো। আর্থিক সংকটের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে ‘কী হবে’ স্ট্রেস টেস্ট (অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে স্থিতিশীল থাকার মতো যথেষ্ট মূলধন ব্যাংকের আছে কিনা তা পরীক্ষা) দ্রুতই অনেকটা সোনার মানের মতো হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালের প্রথম স্ট্রেস টেস্ট এ সংকটের কথা কার্যকরভাবে তুলে ধরে। সেই টেস্টে উঠে আসা নতুন মূলধনের বড় বড় ব্যাংক এরই মধ্যে তীব্র মন্দার বড় আঘাত সহ্য করেছে।
যা-ই হোক, সময়ের সঙ্গে স্ট্রেস টেস্টের অর্থহীন পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। বড় বড় ব্যাংক এর মাধ্যমে নিজেদের জন্য অর্থনৈতিক মূলধনের কুশন তৈরি করে নেয়, যাতে করে বড় মন্দার ধাক্কাতেও তারা পদ্ধতিগত ব্যর্থতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। ট্রেজারি সেক্রেটারি, ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ার, ব্যাংকের সিইও, এমনকি প্রেসিডেন্টও যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক পদ্ধতি যা একসময় খুব ভালো অবস্থানে ছিল সেটি উন্নত করার জন্য সর্বসম্মত ছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেড এ স্ট্রেস টেস্টকে কিছু প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা চর্চার এবং মূলধন সক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহার করবে। তবে এখন পর্যন্ত এটি একটি কবজের মতো করেই কাজ করেছে।
সম্প্রতি আমরা বেশ বড় টুইস্ট আসতে দেখেছি, কারণ স্ট্রেস টেস্ট বেশকিছু ধাক্কার মুখে পড়েছে। এটি একটি সামঞ্জস্যহীন ঝুঁকি মূল্যায়ন চর্চায় পরিণত হয়েছে, যা দিয়ে বড় বড় পদ্ধতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকের পারফরম্যান্স পরীক্ষা করা যায়, ‘কাগজে কলমে তীব্র মন্দার’ ক্ষেত্রে। ফেডের কর্মীরা বৈশ্বিক জিডিপিতে তীক্ষ্ণ পতন, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া এবং সম্পদের বাজার নিমজ্জিত হওয়ার মতো প্রভাবের মডেল তৈরি করেছিলেন। এসব ধাক্কা নতুন মূল্যস্ফীতি ও কমে যাওয়া সুদহারের কারণে প্রভাবিত হয়েছে।
তবে কাগজে-কলমে ধাক্কাটি এসভিবির ওপর আঘাত হানা সুদহারের ধাক্কার তুলনায় ব্যতিক্রম। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা স্ট্রেস টেস্টের ভিত্তিতে ফেড জানায়, ভিন্ন ভিন্ন ধাক্কার বিষয়ে আরো বিস্তৃত আকারে চিন্তা করতে হবে এবং একটি নতুন ‘এক্সপ্লোরেটরি মার্কেট শক’-এর (মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার কারণে তৈরি হওয়া মূল্যস্ফীতি) আশঙ্কাও রয়েছে। উচ্চমূল্যস্ফীতিসহ এখনো মন্দা রয়েছে। তবে এ পরীক্ষণের ফলাফলের নিচে ফেড নোট দিয়েছে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত কোনো দৃঢ় নির্দিষ্ট বিস্ফোরক ফলাফল পাওয়া যাবে না। এমন কোনো লক্ষণও নেই এ ধরনের ফলাফল ছোট ছোট আঞ্চলিক ব্যাংকের ক্ষেত্রেও আসবে।
সুতরাং, চীন এবং চীন-আমেরিকার ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের সঙ্গে এর সংযোগ কী? গত ২০ বছরে চীনের নেতৃত্বের অধীনে জ্যেষ্ঠদের একটি গ্রুপ জানায়, আমেরিকা এখন ক্রমাগত অবনতির পর্যায়ে রয়েছে, যা চীনের বিশ্বব্যাপী উত্থানের সূচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পর এ দর্শন আরো অনেকেই সমর্থন করছেন এবং আরো নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক পদ্ধতির একটি নতুন অংশে আঘাত করায় তা আরো বেশি সমর্থন লাভ করবে।
উদীয়মান চীনের আর বেশি কী দরকার। এমন একটি সময়ে যখন পশ্চিমা আর্থিক পদ্ধতি আরো একবার নিজেদের প্ররোচিত প্রতিবন্ধকতায় ভুগছে, তখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ক্রেমলিনে একে অন্যকে ‘প্রিয় বন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দেয়ার চিত্রই অনেক কিছু বলে দেয়। নিজেদের ভূ-কৌশলগত আধিপত্য আরো শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে স্নায়ুযুদ্ধ এবং ইউক্রেনের গণহত্যাকে একটি ছোট মূল্যপ্রদান হিসেবেই দেখছে চীন।
পতনশীল আমেরিকা সম্পর্কে চীনের দৃষ্টিভঙ্গির একটি গুরুত্বপূর্ণ পাদটীকা রয়েছে। মাও বিস্তৃত পরিভাষায় ইঙ্গিত করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি কাগজের বাঘ। যেটি মৃত্যুশয্যায় সংগ্রামের মধ্যে রয়েছে। যুক্তিটি প্রথম ওয়াং হান্টিং তার ১৯৯১ সালের বই ‘আমেরিকা অ্যাগেইনস্ট আমেরিকা’য় উল্লেখ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সময় ওয়াংয়ের প্রথম পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বইটি আমেরিকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কঠোর সমালোচনা করেছিল।
সবশেষে বলা যায়, এসবই চীনের ব্যুৎপত্তিতে সাহায্য করছে। মান্ডারিন ভাষায় ওইজি শব্দটির দুটি অর্থ—বিপদ ও সুযোগ। এসভিবি থেকে শুরু করে ওয়াং হান্টিং চীন-আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়ার বিন্দু। সংকটপ্রবণ আমেরিকার দিকে একটি স্থির লক্ষ্য নিয়েই তাকাচ্ছে উদীয়মান চীন।
[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]
স্টিফেন এস রোচ: ইয়েল ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি মেম্বার, মরগান স্ট্যানলি এশিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান, আনব্যালান্সড: দ্য কো-ডিপেনডেন্সি অব আমেরিকা অ্যান্ড চায়না, অ্যাকসিডেন্টাল কনফ্লিক্ট: আমেরিকা, চীন অ্যান্ড দ্য ক্ল্যাশ অব ফলস ন্যারেটিভস বইয়ের লেখক
ভাষান্তর: শর্মিলা সিনড্রেলা