কূটনীতিকদের তৎপরতা রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে না

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী সম্প্রতি জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। বামপন্থী রাজনীতি দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করা  নেতা রাজপথে নানা লড়াই-সংগ্রামের কারণে অগ্নিকন্যা হিসেবে পরিচিতি পান। সমসাময়িক রাজনীতিগণতন্ত্রের চর্চা, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ তৌফিকুর রহমান

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই।

একটা রাজনৈতিক দল যদি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করে তাহলে সেই দলকে প্রতিটি দিনই নির্বাচন করতে হয়। যেমন একজন সংসদ সদস্য অথবা একজন সংসদ সদস্য প্রার্থীর কাছে যখন এলাকার মানুষ আসে, তখন তার ভয়েসটা এক রকম হয় এবং বাইরের মানুষ যখন আসে, তখন ভয়েসটা ফরমাল হয়। সুতরাং আমরা যারা রাজনীতি করি, নির্বাচন করিপ্রতিদিনই আমরা পরীক্ষা দিই। একটা প্রবাদ আছে—‘মৃত্যু সবাইকে সমান করে দেয় নির্বাচনও তেমনবুলডোজারের মতো সবাইকে সমান করে দেয়।

প্রত্যেক দিনই আমাদের নির্বাচন করতে হয়। এটাই গণতন্ত্র। যদি গণতন্ত্রের চর্চা থাকে, তাহলে মানুষকে অনেক সংযত হতে হয়। তা না হলে অন্যভাবে চলতে চাইলে সেটি ভিন্ন কথা।

নির্বাচন এলেই বাংলাদেশে বিদেশী কূটনীতিকদের তৎপরতা চোখে পড়ে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকের মন্তব্য আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রসঙ্গে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।

তারা দেশে চাকরি করতে এসেছে। তাদের প্রগ্রেস রিপোর্ট পাঠাতে হয়, তারা পাঠাচ্ছে। আসলে ব্যাপার হচ্ছে নিয়ামক শক্তি হচ্ছে জনগণ। আমাদের গণতন্ত্র আমাদের জনগণআমরা তাদেরই রায় নেব। তারা আমাদের ভালো-মন্দ বিচার করবে।

কূটনীতিকদের তো হেড অফিসে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। তারা পাঠাচ্ছেন। আমি এটা নিয়ে কটু কথা বলতে চাই না। কিন্তু আমাদের নিয়ামক শক্তি হচ্ছে জনগণ, এটা আমি বুঝি। অনেকে অনেক খেলা করতে চায়। বড় দেশগুলো প্রভাবের বলয় নিয়ে খেলে, খেলতে চায়। তবে তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করবে না, নিয়ামক শক্তি হবে না। দেশের নিয়ামক শক্তি হচ্ছে জনগণ। জনগণকে সেবা দিতে পারলে আমি মনে করি তারা আমাদের পক্ষেই রায় দেবে।

আওয়ামী লীগসহ অনেক দলই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। তবে বিএনপি বলছে তারা আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। দেশের দুটি বড় দলের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানের প্রভাব কেমন হতে পারে?

আমার মনে হয়, নির্বাচনের যে কাঠামো রয়েছে বিএনপি সেটি মেনেই নির্বাচন করবে। নির্বাচন হলো জনসমর্থনের নিরিখ, আর গণতন্ত্রের একটা কাঠামো, একটা ধাপ। এটা বাদ দিয়ে কেউ কিছুদিন হয়তো সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মতো কার্যক্রম চালাতে পারে। কিন্তু মানুষ ধারাবাহিকতা চায়। নির্বাচনের মাধ্যমেই মানুষ পরিবর্তনটা করে।

বর্তমানে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি রাজপথে আন্দোলন করছে। বিএনপির চলমান আন্দোলন নিয়ে আপনার সার্বিক মূল্যায়ন জানতে চাই।

তারা আন্দোলন করবে। গণতন্ত্রের চর্চায় তাদের বাধা দেব কেন? তাদেরও পার্টির কর্মীদের ব্যতিব্যস্ত রাখতে হয়। একটা সংগঠনে কাজ না থাকলে মরিচা ধরে যায়। তারাও করছে, করুক। এটা নিয়ে তো আমরা কোনো কটু কথা বলেছি বলে আমার মনে পড়ে না।

প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার বিরোধী দলগুলোর সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের সমাবেশে বাধা, হামলা গাড়ি বন্ধের অভিযোগ করা হচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

তারা তো অভিযোগ করছেই, তাদের একটা কিছু তো বলতে হবে। তাদের সংগঠনটাকে সচল রাখতে হবে। তাদের নেত্রী তো গৃহবন্দি না, শারীরিক কারণে তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। তাদের তারেক রহমান বিদেশে।

কোকো মারা গেলে আমাদের নেত্রী গেলেন। তারা গেট খোলেনি। নেত্রী ছোট গেট দিয়ে ঢুকতে চাইলেন, তারপর সেটাও বন্ধ করে দেয়া হলো। কাজেই বিএনপি রাজনৈতিক ভদ্রতা জানে না। সামান্য শিষ্টাচার তারা দেখাতে পারেনি, এটা প্রমাণিত। এখন তারা পদত্যাগ করেছে। যদিও তারা ইলেকশনে আসেনি। এখন তারা পদত্যাগ করে কীভাবে? তারা তো নির্বাচনই বয়কট করেছিল। এটা হচ্ছে একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা, অর্থাৎ এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস।

সংসদ উপনেতা হিসেবে নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন। দায়িত্ব পেয়ে আপনি কেমন অনুভব করছেন?

নতুন দায়িত্ব পেয়েছি, ভালো লাগছে। চেষ্টা করছি দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে। আমি আগেও বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি। আমি ১৯৭৯-তে আওয়ামী লীগে যোগদান করি, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা দেশে এসেছেন ৮১-তে। ১৯৮৬ সালের সম্মেলনে আমি দলের কৃষি সম্পাদক হই। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা সরকারে এসে আমাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন। আর কিছু না হোক কৃষি নিয়ে কিছু লিখতে গেলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা যখন আসবে, তখন আমার কথা লিখতে হবে। সুযোগটাও শেখ হাসিনা দিয়েছেন।

ব্রিটিশ শাসনামলে আপনার জন্ম, তার পর পরই দেশভাগ। আপনি ১৯৫২ সালে জামালপুরে স্কুলে থাকা অবস্থায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গিয়েছেন। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় বহুবার কারাবরণও করেছেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটটা কেমন ছিল?

ভাষা আন্দোলনের মিছিলে না বুঝেই গিয়েছিলাম। সে সময়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না। তখন মাত্র ১০ বছর বয়স। তবে এটুকু বুঝেছিলাম ছাত্রদের মেরে ফেলেছে। কী কারণে মেরেছে, কীভাবে মেরেছে, তখন ওই মফস্বল শহরে থেকে বুঝতে পারিনি। সে সময় একদিকে ছিল স্বৈরশাসন, অন্যদিকে ছিল বিজাতীয় শাসন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এখনো দেশের মানুষের মন, তাদের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে চেষ্টা করেনি। তারা অঞ্চলকে একটা উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। জিন্নাহ সাহেব পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, উর্দু শ্যাল বি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের আর চারটি প্রদেশেরও ভাষা ছিল না। উর্দু শব্দটা এসেছে উর্দি থেকে। অর্থাৎ ওটা ছিল ব্যারাকের ভাষা। ব্যারাকের ভাষাকে উনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন।

সেই বারো ভূঁইয়ার সময় থেকে বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। নূরলদীনের সময় থেকে সংগ্রামের ইতিহাস আছে। কাজেই বাঙালি এটা মানবে কেন, মানেনি। সুতরাং ভাষা আন্দোলন ছিল অঙ্কুর, আর মহীরুহ ছিল স্বাধীনতা।

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বেশকিছু বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এগুলো আওয়ামী লীগকে কতটুকু সহায়তা করবে?

মানুষ সরকারের কাছে সেবা চায়। সেটা একসময় পায়নি। কিন্তু আমাদের নেত্রী মানুষকে সেবাটা দিয়েই মানুষের কাছে গেছেন। উনি কথার ফুলঝুরি ছিটিয়ে ভোট নেন না। এর আগে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। এছাড়া বিনা পয়সায় বই দেয়া, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, বাচ্চাদের মায়ের নাম সরকারি কাজে নিয়ে আসা অধিকারগুলো শেখ হাসিনাই দিয়েছেন। খালেদা জিয়াও তো নারী ছিলেন, উনি কিন্তু মায়ের নামের কথা ভাবেননি। এগুলো বিবেচ্য বিষয়।

কভিড রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলছে; বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আগামী নির্বাচনে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা?

কিছু তাপ-উত্তাপ আমাদের ওপরে পড়ছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জিনিসগুলো সামলে উঠছেন। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে আমাদের আরো ভালো থাকার কথা ছিল, আমরা আরো ভালো থাকতে পারতাম। দৈনন্দিন জীবনে বা রাষ্ট্রীয় জীবনে তো কিছু কাটছাঁট করতে হচ্ছে। তবে কোথাও কিছু থেমে নেই, বুড়িগঙ্গা বয়েই চলেছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় পানির কমতি হয়নি।

আপনাদের সময়ের ছাত্র রাজনীতি এখনকার ছাত্র রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য কেমন?

আমাদের সময়ে রক্তচক্ষুটা বেশি ছিল। এখন গণতান্ত্রিক দেশ। অনেকেই রাজনীতি করছে। যেমন আমি যখন স্বতন্ত্রভাবে ইডেনে ভিপি প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন আমার বাবার ওপর প্রচুর চাপ এসেছিল। কিন্তু এখন আমার মনে হয়, অভিভাবকদের ওপর সেই চাপটা আসে না। বরং শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের কাছ থেকে উৎসাহটাও পায়। তবে আমার বাবা আমাকে বাধা দেননি, কিন্তু আমার কারণে তাকে যথেষ্ট মাশুল দিতে হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন