মানুষের পাখি হয়ে ওঠা

ওয়াহিদ সুজন

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া সিনেমার দৃশ্য

কুড়া হাওর অঞ্চলের পাখি। মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে হাসন রাজার গান বা হাওর অঞ্চলের মানুষ, কার মুখে নেই এ পাখির নাম! আজকাল যতটুকু খবর পাই, নিজ অঞ্চল থেকে হারাতে বসেছে কুড়া। নির্দিষ্ট বাস্তুসংস্থান থেকে একটি পাখি হারিয়ে যাওয়ার সোজাসাপ্টা মানে হলো ওই বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এভাবে একটি প্রজাতি ধরে এগোলে ধীরে ধীরে বাকিদের খবরও পাওয়া যায়। কুড়া পাখি দিচ্ছে হাওরের অন্দরের খবর।

কুড়ার বিলুপ্তি ও বাস্তুচ্যুত মানুষের গল্প একই না হলেও স্থানিক পরিচয় হারানোর পর মানুষও হয়তো আগের মানুষটা থাকে না। ফলে মেটাফর হিসেবে মানুষও শূন্যে উড়াল দিতে পারে। তারা কোথায় যায়, কেন যায়? ‘কেন যায়’-এর উত্তর খুঁজতে গেলে মানুষ ও পাখি একই সমান্তরালে দাঁড়িয়ে বিপর্যয়ের তথ্য দেয়। সে তথ্য থেকে তত্ত্বের তালাশে গেলে আমরা বুঝতে পারি, প্রাণ-প্রকৃতি থেকে মানুষ আলাদা না হলেও আমরা তাকে আলাদাভাবে দেখতে শিখেছি। যদিও তারা আলাদা নয়। শুধু প্রয়োজন নয়, এ যে আত্মার সম্পর্ক। সেই পুরনো কথা আবারো বলছি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ প্রসঙ্গে।

মুহাম্মদ কাইউমের ছবি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ হাইব্রিড ঘরানার নির্মাণ। ফিকশন আর নন-ফিকশনের একটা লিনিয়ার বর্ণনা আছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের পাশাপাশি সিনেমায় এ ঘরানার সামান্য কিছু কাজ হয়েছে। আগেই বলেছি, এ সিনেমায় হাওর অঞ্চলের গল্প এসেছে। হাওরের পানি এ অঞ্চলের জীবনপ্রবাহের মূল উৎস। যে একই সঙ্গে এ ছবির নায়ক ও ভিলেন। 

নেত্রকোনার দুর্গাপুর থেকে আসা এক নিঃস্ব তরুণের (উজ্জ্বল কবির হিমু) চোখে হাওর ও এ অঞ্চলের জীবনের টানাপোড়নের গল্প উঠে এসেছে সিনেমায়। জাদুকাটা নদী ও অন্যান্য জলাধারের বর্ণনা থেকে মনে হয়, অঞ্চলটি টাঙ্গুয়ার হাওর বা কাছাকাছি অঞ্চলের। ওই তরুণ যা দেখে, দর্শকও তা দেখে ও জানে। অর্থাৎ, পরিচিতিমূলক একটি বিষয় আছে। মূলত সিনেমার দর্শক অর্থাৎ শহুরে মানুষের কাছেই এ পরিচয়। যেখানে কথকের ভূমিকায় থাকে ছবির সব চরিত্র ও বোবা প্রকৃতি।

কখনো ঘটতে থাকা ঘটনা, আর কখনো অন্যের বরাত দিয়ে আমরা ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’র গল্প শুনতে থাকি। বাদ যায় না, ছোট্ট রুকু। সে আমাদের শোনায় কুড়া পক্ষীর গল্প। সে গল্প শুনতে শুনতে একসময় আমরা টের পাই হাওরের মানুষও মূলত কুড়া পক্ষী। এ জায়গায় ছবির চমৎকারিত্ব। যদিও ঘটনাপ্রবাহ ও চিত্রায়ণ মিলিয়ে মনে হয় নির্মাতা হাওর ও গরিব মানুষ সম্পর্কিত পূর্বানুমানগুলো এ সিনেমায় প্রয়োগ করেছেন। হয়তো এটা তার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাও। সে দিক থেকে আরেকটু গভীরতা প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু একটি শিল্প আসলে ততটুকুই, যতটুকু নির্মাতা আমাদের দেখাতে পারেন বা চিন্তা করতে দিতে পারেন। এ নিরিখে ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’য় চিন্তার যথেষ্ট উপাদান আছে। 

এ ছবির চিত্রায়ণ সবচেয়ে মনোযোগ কাড়ে। যদিও হাওরে যাওয়া দুর্লঙ্ঘ্য কোনো বিষয় নয় আজকাল। রোজ রোজ অনেক পর্যটক গিয়েও থাকে। তবে এতটুকু যথেষ্ট নয়, ভ্রমণ বা পর্যটন কতটা মানুষের সঙ্গে মানুষের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে ওঠে। শৌখিন ভ্রমণে যাদের সম্পর্কে কখনো জানা হয় না, হয়তো তার গরিবিয়ানা ও কখনো কখনো তাদের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হই; সে জীবনকে ধরার চেষ্টা এ ছবি। এমনিতে হাওরের এক টুকরো ছবির কী মূল্য, যদি তাতে প্রাণ আরোপ করা না যায়। হতে পারে হাওরে পানির আসা-যাওয়া, ফসলের গল্প। তবে আমরা বোধহয় আরো কিছু চাই। তাই কুড়া আর মানুষের গল্প সমান্তরালে আসে। এ তুলনাটুকু মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আরো স্বার্থপরভাবে বললে, বস্তুত মানুষের শিল্পবোধ এমন যে শুধু প্রকৃতিকে আলাদাভাবে দেখালে চলে না, সেখানে কোথাও না কোথাও নিজেকে স্থাপন করতে হয়। এ ছবি দেখলে এমনটা মনে পড়ে যায়। যদিও ক্ষুধার্তের ভাষা হয়ে ওঠা সিনেমা বাংলায় বিরল নয়, তবে স্থানিকভাবে এ ছবি অবশ্য আলাদা।

আরো খানিকটা কালচারাল অনুষঙ্গ চোখে পড়ে, ভালোও লাগে। হাওর আর ধামাইল গান আলাদা করা যায় না, বিয়ের এ গান দর্শক উপভোগ করেছে। ছবির চরিত্রগুলো কোনো চিহ্ন  দিয়ে নির্দিষ্ট ধর্মীয় বর্গের প্রতিনিধিত্ব না করলেও ফসলের মঙ্গলের জন্য তেলগাছি পূজা, ক্ষেত বান্ধার পূজা ও অদ্বৈতাচার্যের স্নান ঘিরে মেলা সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির হয়। এখানে সব ধর্মের মিলনের কথাও বলা হয়। এদিক থেকে একটা ন্যূনতম পর্যায়ে ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ডকুমেন্টশন হয়ে ওঠে।

সিনেমাটি এও দেখিয়ে দেয়, শহরের পথে-ঘাটে হঠাৎ দেখা ও পরমুহূর্তে ভুলে যাওয়া সেসব সম্বলহীন মানুষেরও হয়তো একসময় সব ছিল। আশ্রয় ছিল, নিজের মতো করে বাঁচার স্বপ্ন ছিল, যেখানে প্রাণ-প্রকৃতির নিজস্ব সুর-সংগীত ছিল। তাদের স্বতন্ত্র সত্তাকে দেখিয়ে দেয়। হ্যাঁ, এখন হয়তো কিছু নেই, শুধু স্বপ্ন আছে, অথবা তাও নেই। এই থাকা না থাকার মাঝে ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ তাদের নিয়ে ভাবায়, অন্যকে ভালোবাসতে বলে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন