নির্মূল করা না গেলেও নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব

ডা. কাজী সাইফউদ্দীন বেন্নূর

মানব জীবনের সূচনা হয় সদ্যোজাত শিশুর প্রথম কান্না দিয়ে। প্রথমবারের মতো শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে শ্বাসনালি এবং ফুসফুসে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে বাতাস গ্রহণ করে সে জানান দেয়আমি এসেছি, আমি বেঁচে আছি। পার্থিব জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করা পর্যন্ত চলতে থাকে প্রক্রিয়া। শ্বাসতন্ত্র ফুসফুসের সুস্থতা বজায় রাখা আমাদের জন্য তাই অতি অপরিহার্য।

শ্বাসতন্ত্রের বেশকিছু রোগব্যাধির সঙ্গে আমরা পরিচিত। তার মধ্যে নিউমোনিয়া অন্যতম। এটি জীবাণু সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট ফুসফুসের প্রদাহজনিত একটি রোগ। এতে ফুসফুসের ভেতরে এক বা একাধিক জায়গায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বায়ুথলি দূষিত রস বা পুঁজে ভরে ওঠে। ফলে স্পঞ্জের মতো নরম ফুসফুসের সেই জায়গাগুলো তার কোমলতা হারিয়ে জমাট বেঁধে থোকার মতো হয়ে যায়। ফুসফুসের সেই অংশ দিয়ে জীবন ধারণের জন্য অতি আবশ্যকীয় অক্সিজেন রক্তনালিতে ঢুকতে পারে না এবং দূষিত গ্যাসও শরীর থেকে বের হতে পারে না। অক্সিজেনের অভাবে বিষাক্ত বর্জ্য গ্যাসের প্রভাবে দেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। সঠিক চিকিৎসা না হলে ফুসফুসের আক্রান্ত স্থানগুলো চিরতরে অকেজো হয়ে যায় একপর্যায়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক সংক্রমণের কারণে নিউমোনিয়া হয়। জীবাণুগুলো আশপাশের সামাজিক পরিবেশ থেকে (কমিউনিটি অ্যাকুয়ার্ড নিউমোনিয়া), হাসপাতালে থাকাকালীন অন্য রোগীর থেকে (হসপিটাল অ্যাকুয়ার্ড নিউমোনিয়া) অথবা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকা রোগীর ভেন্টিলেটর থেকে (ভেন্টিলেটর অ্যাসোসিয়েটেড নিউমোনিয়া) রোগীর দেহে সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়া অসাবধানতা বা অসুস্থতার কারণে খাবার, পানীয় বা লালা খাদ্যনালি থেকে শ্বাসনালিতে ঢুকে গেলেও এক ধরনের নিউমোনিয়া হয়ে থাকে (অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া) দুই বছর বা তার কমবয়সী শিশুদের ঘন ঘন  নিউমোনিয়া হতে পারে। এই নিউমোনিয়া সাধারণত ভাইরাসজনিত এবং এতে আক্রান্ত রোগী অল্প চিকিৎসা সেবাযত্নেই সুস্থ হয়ে ওঠে। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তি, ধূমপায়ী, যারা দীর্ঘদিন কোনো রোগে ভুগছে, ক্যান্সার বা অন্য কোনো কারণে কেমোথেরাপি নিচ্ছে অথবা যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল বা কম তাদের মধ্যে নিউমোনিয়া বেশি দেখা যায়। তবে অল্প বয়স্ক বা স্বাস্থ্যবান মানুষের যে নিউমোনিয়া হবেই না, তা নয়।

নিউমোনিয়ার প্রধান লক্ষণগুলো হচ্ছে জ্বর, সর্দি ঘাম, কফসহ অথবা শুষ্ক কাশি, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব বমি, হাতে-পায়ে বা সারা শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, ক্লান্তি বিভ্রান্তি।

এসব লক্ষণ দেখা দিলেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

নিউমোনিয়া নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস ক্লিনিক্যাল উপস্থাপনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত নিউমোনিয়া সন্দেহ হলে চিকিৎসকরা উপশমকারী চিকিৎসার পাশাপাশি একটি বিস্তৃত ক্ষমতার (ব্রড স্পেকট্রাম) অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে থাকেন। যেসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসার পরেও উপসর্গের উপশম হয় না, সেখানে নিউমোনিয়ার মূল কারণ নির্ণয় শনাক্ত করার জন্য বেশকিছু পরীক্ষা করা যেতে পারে। নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রচলিত পরীক্ষাগুলোর মধ্যে রয়েছে

রক্ত পরীক্ষা

কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি): জীবাণু সংক্রমণ থাকলে রক্তে উপস্থিত শ্বেত রক্তকণিকা বা ডব্লিউবিসির সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে।

সেরাম ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা: সংক্রমণের তীব্রতা গতিবিধি নির্ধারণের জন্য রক্তে সোডিয়াম, পটাশিয়াম অন্যান্য উপাদানের মাত্রা পরিমাপ করা হয়।

ধমনি রক্তের গ্যাস (এবিজি) পরীক্ষা: পরীক্ষার মাধ্যমে পিএইচ মাত্রা এবং রক্তে অক্সিজেন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়। এটি ফুসফুসের কার্যকারিতার মাত্রা নির্দেশ করে থাকে।

ব্লাড কালচার: রক্তে জীবাণুর সংক্রমণ রয়েছে সন্দেহ হলে পরীক্ষার পরামর্শ দেন চিকিৎসক।

রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা

বুকের এক্স-রে: ফুসফুসের আক্রান্ত অংশটি বুকের এক্স-রেতে এক ধরনের দাগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এক্স-রে ফুসফুসের সংক্রমণের তীব্রতাও শনাক্ত করে থাকে। চিকিৎসার পর রোগীর উন্নতি বোঝার জন্যও এটি দরকারি।

কম্পিউটেড টমোগ্রাফি স্ক্যান (সিটি স্ক্যান): প্রয়োজনে সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে অধিকতর নিখুঁতভাবে ফুসফুসের গঠন এবং নিউমোনিয়ার কারণে সৃষ্ট পরিবর্তনগুলো শনাক্ত মূল্যায়ন করা যায়।

কফ অন্যান্য দেহ-রসের পরীক্ষা

স্পুটাম বা কফ কালচার: নির্দিষ্ট কোনো জীবাণুর সংক্রমণে নিউমোনিয়া হয়েছে এবং কোন অ্যান্টিবায়োটিক তার বিরুদ্ধে কার্যকরী, তা পরীক্ষায় বোঝা যায়।

এসিড-ফাস্ট ব্যাসিলাই (এএফবি) স্মিয়ার অ্যান্ড কালচার: নিউমোনিয়ার মতো যক্ষ্মারও উপসর্গ একই রকম হয়ে থাকে। ফুসফুসে যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করার জন্য পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।

প্লুরাল ফ্লুইড অ্যানালাইসিস: কখনো কখনো ফুসফুসের চারপাশের পর্দার (প্লুরা) মধ্যে তরল জমা হয়। তরল বের করে নিউমোনিয়ার কারণ শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়।

এছাড়া পরিস্থিতি প্রয়োজন বিবেচনায় চিকিৎসকরা আরো কিছু পরীক্ষা করিয়ে থাকেন।

নিউমোনিয়া চিকিৎসায় রোগীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রচুর বিশ্রাম, বেশি করে তরল পান নির্ধারিত ওষুধ সেবন। এগুলো নিউমোনিয়ার জটিলতার ঝুঁকি হ্রাস দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করতে পারে।

নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় প্রধানত যেসব ওষুধ ব্যবহার হয়

অ্যান্টিবায়োটিক: ওষুধগুলো ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে কাজ করে। নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে ডাক্তার প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক নির্ধারণ করেন। উপসর্গ লাঘব না হলে অ্যান্টিবায়োটিক বদল করা হয়।

কাশির ওষুধ: মাত্রাতিরিক্ত কাশি রোগীদের জন্য খুবই কষ্টকর। কাশির ওষুধ কাশির দমক কমিয়ে রোগীকে বিশ্রাম নিতে সহায়তা করে। তবে ফুসফুস থেকে বর্জ্য তরল বের করার জন্য কাশির প্রয়োজনীয়তা আছে। ধরনের ক্ষেত্রে কাশির ওষুধের ডোজ কম করে দেয়া যেতে পারে। তাই না বুঝে অতিরিক্ত কাশির ওষুধ গ্রহণ করা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

অ্যান্টিপাইরেটিকস: যখন একজন ব্যক্তি সংক্রমণের সময় জ্বর ব্যথার কারণে অস্বস্তি অনুভব করে তখন প্যারাসিটামলের মতো জ্বর ব্যথা কমানোর ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।

মনে রাখতে হবে, গুরুতর সংক্রমণ হলে, বয়োবৃদ্ধ রোগীর ক্ষেত্রেরোগী অন্য কোনো ক্রনিক রোগে ভুগলে, তীব্র শ্বাসকষ্ট হলে অথবা মানসিক বিভ্রান্তি দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই যুক্তিযুক্ত। শিশুদের নিউমোনিয়া সাধারণত দ্রুত ভালো হয়ে যায়। শিশুর বয়স দুই মাসের কম হলে, বাচ্চা অতিরিক্ত নিরুদ্যম হয়ে পড়লে, উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর থাকলে, তীব্র শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে অথবা শিশুর দেহে পানিশূন্যতা দেখা দিলে তাদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন।

নিউমোনিয়া প্রতিরোধে টিকা প্রদানের গুরুত্বও অনেক। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে এই টিকা নিতে দ্বিধা করা উচিত নয়। অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যেমন ঘন ঘন ভালোভাবে হাত ধোয়া, হাঁচি দেয়ার সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা, আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়িয়ে চলা ধূমপান বন্ধ করা খুবই জরুরি।

সঠিক চিকিৎসা সাবধানতার মাধ্যমে নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব। তা সত্ত্বেও প্রতি বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ১০ শতাংশ নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করে। শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর মাত্রা বেশি। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় লাখ ২০ হাজার সদ্যোজাত শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। বাংলাদেশে এটি শিশুমৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। প্রতি দুই ঘণ্টায় গড়ে তিনজন শিশু দেশে নিউমোনিয়ায় প্রাণ হারায়।

নিউমোনিয়ার ভয়াবহতা কমিয়ে আনতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের মাতৃদুগ্ধ পান, সময়মতো টিকা নেয়া, সুষম খাদ্যাভ্যাস, দূষণমুক্ত পরিবেশ, শারীরিক ব্যায়াম, ধূমপান অন্যান্য বদভ্যাস পরিত্যাগ ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা নিউমোনিয়াকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারি। নিউমোনিয়া হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে কখনোই দেরি করা উচিত নয়। সম্পূর্ণরূপে নির্মূল না করা গেলেও নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই সম্ভব।

 

লেখক: বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ

লাং ফাউন্ডেশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন