ডেঙ্গু

নিয়ন্ত্রণে দরকার জাতীয় কর্মকৌশল

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) দেশে সংক্রামক অসংক্রামক রোগের নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায় থেকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করেছেন তিনি। সম্প্রতি ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব, রোগ রোগী ব্যবস্থাপনা, ডেঙ্গু প্রতিরোধের কর্মকৌশল নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

করোনা মহামারীর মধ্যেই চলতি বছর ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগ আশঙ্কাজনক বেড়েছে। বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ কী?

দুটি কারণ। একটি হলো আবহাওয়া। এবার বৃষ্টি মৌসুম দীর্ঘায়িত হয়েছে। অক্টোবরেও বৃষ্টি হয়েছে। নিম্নচাপ আছে, যার ফলে এটা আরো কিছুদিন কন্টিনিউ করতে পারে। এডিস মশা প্রজননের জন্য পানি দরকার। বৃষ্টি সেই পানির অন্যতম উৎস। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ডেঙ্গু হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। এবার যেহেতু দীর্ঘদিন থেকে বৃষ্টি হচ্ছে তাই দীর্ঘদিন থেকে পুঞ্জীভূত যে সংক্রমণ সেটা বাড়ছে। প্রথমদিকে হয়তো ২০ জন বা ৫০ জন আক্রান্ত হয়েছে। পরে বৃষ্টির কারণে এডিসের সংখ্যা বেড়েছে। এভাবে রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।

দ্বিতীয়ত, একসঙ্গে দুটি ভাইরাসের সংক্রমণ সাধারণত হয় না। করোনাভাইরাস যেহেতু কমে গেছে, সেই জায়গা দখল করেছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গুর যে চারটা ধরন আছে, ঢাকায় এর সবগুলোর মাধ্যমেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। যদি ঢাকা শহরে ডেঙ্গু আক্রান্তের খোঁজ করা হয় তাহালে দেখা যাবে কেউ একটা বা দুটো, আবার কেউ তিনটা এমনকি চারটা ধরনের মাধ্যমেই সংক্রমিত হয়েছে। আগে আক্রান্ত হয়নি এমন ধরনের মাধ্যমে নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি ঢাকায়। তবে ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি ভিন্ন। সেখানে আগে যেহেতু কোনো সংক্রমণ হয়নি, তাই যেকোনো একটা ধরনের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ না থেকে এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কেন এমন হয়েছে?

ডেঙ্গুর সঙ্গে নগরায়ণের একটা সম্পর্ক আছে। বিষয়টা হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ।  আজকাল বিভিন্ন ভবনের মাঝে ১০ ফুট ফাঁকা থাকে, সেই জায়গাটা যদি পরিষ্কার রাখা যেত তাহলে পানি জমে থাকত না। ঢাকা শহরে দেড়-দুই ফুট একটা ভবনে ফাঁকা। ওখানে যদি একটা কনটেইনার পড়ে যায়, সেটাতে পানি জমলে শুকাবে না। রাজউক যদি এমনভাবে শর্ত দিত যে ভবন তুলতে হবে এমনভাবে যেন কোনো জায়গায় পানি জমে না থাকে। ভবন করার সময় যখন ঢালাই দেয়া হয় ঢালাইয়ের জায়গা ভিজিয়ে রাখা হয়। এডিস মশা পানিতে ডিম পাড়া থেকে বাচ্চা ফুটাতে সাত-আট দিন লাগে। লার্ভা হতে দুই-চার দিন। এমনকি যদি ডিম পাড়ে, পানি শুকালেও ডিমটা নষ্ট হবে না। আবার যখন বৃষ্টি হবে তখন লার্ভা দেবে। এটা অনেকেই বোঝে না। ফলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না। এভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঢাকার বাইরেও হচ্ছে। আমাদের ৩৫০টি পৌরসভা আছে। জেলা, উপজেলা বিভাগীয় শহরে কিন্তু এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই।

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বাড়ছে। মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার জন্য নির্দিষ্ট কী পদক্ষেপ হতে পারে?

জাতীয় কর্মকৌশল নিতে হবে। তার নাম হবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ জাতীয় কর্মকৌশল সেটা শুধু ঢাকার জন্য না, সারা দেশের জন্য। ম্যালেরিয়া, কালা জ্বরের জন্য কর্মকৌশল আছে। এটার জন্যও একইভাবে কর্মকৌশল করতে হবে। জাতীয় কর্মকৌশল না থাকায় যে কাজ হচ্ছে তা অ্যাডহক ভিত্তিতে হচ্ছে। কর্মকৌশল প্রণয়ন করলে সেটার ভিত্তিতে দেশব্যপী কাজ করা যায়। সেটার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রত্যেক বিভাগে কীটতত্ত্ববিদ ল্যাবরেটরি দরকার। এটা ছাড়া এডিসের মতো একটা চালাক বাহককে অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত মশকনিধন কর্মী দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। আগে এসির পানি, টায়ারে ডিম পাড়ত এখন প্লাস্টিকের পটে ডিম পাড়ে। এই যে পরিবর্তন ঘটবে সেটা কে বুঝতে পারবে? বুঝতে হলে কীটতাত্ত্ববিদ লাগবে, গবেষণা করতে হবে।

হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা কি চোখে পড়ছে?

ঢাকা শহরের চিকিৎসকরা ২২ বছর ধরে চিকিৎসা দিচ্ছেন। ঢাকার ব্যাপারে একটা অভিজ্ঞতা আছে। যেহেতু জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের অধীনে কনিষ্ঠ চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিয়ে আসছেন, সেক্ষেত্রে ঢাকায় চিকিৎসা দেয়ার মতো চিকিৎসক আছেন। সমস্যা হলো অন্য রোগীতেই বিভিন্ন ওয়ার্ড ভরপুর থাকে। সেখানে যদি অতিরিক্ত ডেঙ্গু রোগী আসে অন্য বিভাগের রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা পাবে না অথবা ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা পাবে না। সেক্ষেত্রে মৃত্যুর হার বাড়তে পারে। অনেক রোগীর মধ্যে থাকলে আলাদা করে মনোযোগ দেয়া কঠিন। করোনার মতো যদি ডেঙ্গু ওয়ার্ড হতো তাহলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা যা দরকার সেটা নিশ্চিত করা সম্ভব।

হাসপাতালের বাইরে ডেঙ্গু রোগীর ব্যবস্থাপনা কী ধরনের হওয়া উচিত?

ডেঙ্গুর প্রথম চিকিৎসা হলো তরল পানীয়। সেটা পানি বা জুস হতে পারে। আক্রান্তরা যদি প্রচুর পরিমাণ পানি খায়। তার মৃত্যু হবে না বললেই চলে। কারণ ডেঙ্গুর জটিলতা বাড়লে রক্তনালি থেকে পানি বেরিয়ে যায়। পানি বেরিয়ে গেলে ভেতরে রক্তের চাপ কমে গেলে রোগী শকে চলে যাবে। সে যদি অনেক পানি খায় সেটা রক্তনালিতে যায়, সেখানে যে পরিমাণ পানি বেরিয়ে যাচ্ছে আবার সে পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি পানি ঢুকছে। তাহলে ওখানে ক্রিটিক্যাল লেভেলে যেতে পারছে না। যেকোনো জ্বর হলে আমি নিজেই প্রচুর পরিমাণে পানি খাই, কারণ আমি তো জানি না এটা কোন জ্বর। জ্বর হলে পানি উপকার করে। এক নম্বর হলো পানি, আর কোনো চিকিৎসা নেই। আর কোনো ওষুধ নেই।

সেরে ওঠার পরও ডেঙ্গু রোগীর শরীরে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে?

নানা ধরনের জটিলতা হতে পারে। ডেঙ্গুর জটিলতার ওপর রোগীর জটিলতা নির্ভর করে। যদি ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে যায় তাহলে মাল্টি অর্গান অ্যাফেক্টেড হতে পারে। দুর্বলতা দেখা যায় কমন। এছাড়া কিডনি, লিভার, ব্রেনসহ অনেক ধরনের জটিলতা দেখা যেতে পারে।

এডিস মশা নিধন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার আর চিকিৎসার জন্য কাজ করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। দুই বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে কিনা?

সমন্বয়ের চেয়ে বড় সমস্যা হলো যার যে দায়িত্ব সেটা ঠিকভাবে পালন না করা। স্থানীয় সরকার তার দায়িত্বের ভাগ মাত্র পালন করে, বাকি ৯৫ ভাগ যদি পালন না করে তাহলে সমন্বয় করেও এর উন্নতি হবে না। আমাদের যত শহর আছে সেখানে স্বাস্থ্যসেবা স্থানীয় সরকার দেবে বলে নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা একটা আইন আছে। আইনের কারণে স্বাস্থ্য বিভাগ শহরগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে না। এক দেশ, এক স্বাস্থ্য নীতিতে এগোতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগই যেন স্বাস্থ্যসেবা দেয়। কারণ স্থানীয় সরকারের পক্ষে দেয়া সম্ভব না। নগরায়ণ বাড়ছে। আগে ৮০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করত, এখন ৬৭ ভাগ। সামনে ৫০ ভাগ হবে। আইন করে শহরের স্বাস্থ্যসেবা স্বাস্থ্য বিভাগকে দিতে হবে।

গত কয়েক দশকে দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার প্রধান কারণ কী?

বিভিন্ন পদে যারা আছে তারা বিজ্ঞানমনস্ক না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এডিস মশার জীবনচক্র জানতে হবে। এটা বিজ্ঞান। এটা না বুঝে অযথা ফগিং করে রাস্তাঘাট ধোঁয়ায় ঢেকে ফেললেন কিন্তু যেখানে মশা ডিম পাড়া সেখানে কাজ করলেন না। তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে না।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসাধারণের করণীয় সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

সরকার একা পারবে না। এখানে জনসম্পৃক্ততা দরকার। প্রত্যেক ওয়ার্ডে যদি ভবন মালিকদের নিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি করি এবং যদি ঘোষণা দেয়া হয় আমাদের এলাকায় কোথাও কোনো পানি জমে থাকবে না। কাজে যদি ওয়ার্ড কাউন্সিলর সহযোগিতা করেন এবং একইভাবে যদি সব ওয়ার্ডে করা যায় তাহলে ডেঙ্গু হবে না। হলেও খুবই কম হবে। এটা খুব টেকসই মডেল। জনসম্পৃক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা মডেল গড়ে তুলতে পারলে সব ধরনের রোগ প্রতিরোধ করা যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন