কনজাংটিভাইটিস

সচেতন হলেই এড়ানো যায় সংক্রমণ

ডা. দিলীপ কুমার দেবনাথ

সম্প্রতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগ। ঢাকা, চট্টগ্রাম বরিশাল বিভাগের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে রোগটি। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চোখ ওঠা রোগের প্রকোপ সাধারণত বাড়ে, বিশেষ করে গরমে বর্ষায় এর প্রকোপ বেশি দেখা যায়। এখন প্রায় প্রতিটি ঘরেই কেউ না কেউ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি ভাইরাসের ইনফেকশন দ্বারা হয়ে থাকে, যা অতিমাত্রায় সংক্রামক। পাশাপাশি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলে আরো বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। খুব কম ক্ষেত্রেই এটা জটিল আকার ধারণ করে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে রোগটি সম্পর্কে জানা, সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করলে রোগটির জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

কনজাংটিভাইটিস কী?

চোখের সাদা অংশ চোখের পাতার ভেতরের অংশ একটি পাতলা স্বচ্ছ ঝিল্লি বা আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে। সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি চোখের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা করা ঝিল্লিকে বলা হয় কনজাংটিভা। এই ঝিল্লি বা আবরণটির প্রদাহকেই কনজাংটিভাইটিস বলা হয়ে থাকে। এটি পিংক আই নামেও পরিচিত। দেশে রোগটিকে বলা হয় চোখ ওঠা।

কী কী কারণে কনজাংটিভাইটিস হয়?

সাধারণত নানা ধরনের ইনফেকশনের কারণে এটি হতে পারে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হয় ভাইরাসের ইনফেকশনের মাধ্যমে। এছাড়া ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্রটোজোয়া ইত্যাদির ইনফেকশন থেকেও কনজাংটিভাইটিস হতে পারে। ইনফেকশন ছাড়াও অ্যালার্জি আরো কিছু শারীরিক অসুস্থতা থেকে কনজাংটিভাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে।

ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া থেকে যে কনজাংটিভাইটিস হয় তা সাধারণত ছোঁয়াচে, বিশেষ করে ভাইরাস। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বা একই তোয়ালে, গামছা, রুমাল, বালিশের কাভার ব্যবহার করলে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে সেই হাত চোখে লাগালে এটির সংক্রমণ ঘটতে পারে।

দেখা দেয় যেসব সমস্যা

কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠার সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে চোখ লাল হওয়া, চোখের পাতা ফুলে যাওয়া, পানি পড়া, পিছুটি হওয়া, চোখ খচখচ করা, আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা বা তীব্র আলোয় অস্বস্তি লাগা, চোখে ঝাপসা দেখা ইত্যাদি। কোনো কোনো চোখের পাতার ভেতরের অংশে সাদা পর্দা বা আবরণের মতো জমতে পারে, যেটাকে মেমব্রেনাস কনজাংটিভাইটিস বলা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোখের সাদা অংশে রক্ত জমে যেতে পারে বা লালচে রক্তমিশ্রিত পানি পড়তে পারে, যাকে হেমোরেজিক কনজাংটিভাইটিস বলা হয়। মেমব্রেনাস হেমোরেজিক কনজাংটিভাইটিস সাধারণত শিশুদের বেশি হয়। তাই শিশুরা রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চক্ষুবিশেষজ্ঞ দেখিয়ে নেয়া জরুরি।

করণীয় কী?

সাধারণভাবে ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস এমনিতেই -১৪ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। এই সময়ে বেশকিছু বিষয় মেনে চলা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে

* চোখ চুলকানো থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে অপরিচ্ছন্ন হাত চোখে লাগানো যাবে না। বারবার হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।

* রোগীর ব্যবহার করা সামগ্রী অন্যদের ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষত আক্রান্ত ব্যক্তির রুমাল, কাপড়-চোপড়, তোয়ালে ব্যবহার করা যাবে না।

* আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ পরিহার করতে হবে। হ্যান্ডশেকের মাধ্যমেও এটির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই হ্যান্ডশেক করার পর দ্রুত হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। পরিষ্কার না করে কখনই চোখে হাত দেয়া যাবে না।

* শিশুরা আক্রান্ত হলে অবশ্যই চক্ষুবিশেষজ্ঞ দেখিয়ে নিতে হবে। এই সময়ে শিশুকে স্কুলে যেতে দেয়া উচিত নয়। এতে স্কুলের অন্য বাচ্চাদের মধ্যে দ্রুত এটি ছড়াতে পারে।

* সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করতে হবে।

* টিস্যু বা নরম কাপড় দিয়ে সাবধানে চোখ মুছে নিতে হবে। ব্যবহার করা সেই টিস্যু বা কাপড় সাবধানে নিরাপদ স্থানে ফেলতে হবে, যাতে রোগ অন্য কারো মধ্যে সংক্রমিত না হয়।

* আক্রান্ত ব্যক্তি ঘরের বাইরে গেলে সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে, তা না হলে রোদে চোখ জ্বলবে।

চিকিৎসা

* ভাইরাস জ্বরের মতো কনজাংটিভাইটিসও কিছুদিনের মধ্যে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। প্রয়োজনে চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

* চোখ খচখচ অথবা চোখে অস্বস্তির জন্য আর্টিফিসিয়াল টিয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে।

* ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক চোখের ড্রপ (যেমন সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লিভোফ্লক্সাসিন, মক্সিফ্লক্সাসিন, টোব্রামাইসিন ইত্যাদি) মলম ব্যবহার করা প্রয়োজন।

* উভয় ক্ষেত্রেই চোখ ফোলা কমানোর জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন ব্যবহার করা যেতে পারে।

চোখ মানব শরীরের একটি সংবেদনশীল অঙ্গ। তাই এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবশ্যই থাকতে হবে বাড়তি সতর্কতা। সংবেদনশীল এই  অঙ্গের চিকিৎসা রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া না করানোই ভালো। বাংলাদেশে এখন আন্তর্জাতিক মানের সব ধরনের চক্ষু চিকিৎসা সেবা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সারা দেশে যতটা প্রয়োজন তার তুলনায় চক্ষুবিশেষজ্ঞের সংখ্যা বেশ স্বল্প। বর্তমানে সারা দেশে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় এক হাজার চারশ বিশেষজ্ঞ চক্ষু চিকিৎসক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া এবার চোখ ওঠা রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে চোখের ড্রপের সংকট। বিভিন্ন উপজেলার ফার্মেসিগুলোতেও এখন চোখের ড্রপ পেতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাই সতর্ক থেকে রোগে আক্রান্ত হওয়া এড়ানোই হবে যতটা সম্ভব ভালো সমাধান।

 

ডা. দিলীপ কুমার দেবনাথ: সহযোগী অধ্যাপক চক্ষু বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন