ব্যাংকিং সম্মেলন

ব্যাংক খাত বৈশ্বিক প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে

ড. শাহ্ মো. আহসান হাবীব

মূল্যস্ফীতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতি এবং আর্থিক খাতকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা এক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিশ্বব্যাপী। উন্নত উন্নয়নশীল উভয় বিশ্বে প্রতিকূল পরিস্থিতির প্রভাব স্পষ্ট। নীতিনির্ধারকদের জন্য এমন জটিল অবস্থা মোকাবেলা সহজ নয় যখন বিশ্বব্যাপী নিম্ন আয়ের জনপদ এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগ এখনো করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক ব্যাংক খাত অবস্থায় নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতি কভিড-১৯ সংক্রান্ত দুর্যোগ থেকে উত্তরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ব্যাংক খাতের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে নতুন চ্যালেঞ্জ পরীক্ষার মুখোমুখি করেছে। আর্থিক খাত প্রভাবিত হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে।

বৈশ্বিক দুর্যোগ এবং কভিড-১৯-এর কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নতুন জটিল পরিস্থিতির মুখে পরেছে। সুশাসন ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য কিছু মৌলিক বিষয় আগের মতো রয়ে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে সুশাসন সম্পর্কিত বেশকিছু পদক্ষেপ সংশোধন করতে হচ্ছে। অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতিতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং শীর্ষ নেতৃত্বের দায়িত্বশীল আচরণ প্রকৃতই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নতুন পরিস্থিতিতে সব অংশীদারি পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সব অংশীদারি পক্ষের সর্বোচ্চ স্বার্থ সংরক্ষণের যে জনপ্রিয় ধারা চালু রয়েছে বছরের পর বছর, তা নিশ্চিত করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে শীর্ষ নেতৃত্বকে। নতুন পরিস্থিতিতে সমাজ পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে আরো বেশি জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতাও অত্যন্ত জরুরি। তবে এর ফলে যেন পরিচালনা পর্ষদ এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনার মধ্যে যথাযথ দূরত্ব রক্ষা করার মৌলিক নীতি ভঙ্গ হয়ে না যায় তা লক্ষ রাখতে হবে। বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে পরিচালনা পর্ষদ এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনার সংঘবদ্ধ কার্যক্রম চলমান রাখা অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গে প্রয়োজন বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনিয়োগ। কোনো সন্দেহ নেই যে ডিজিটাল প্লাটফর্ম নিশ্চিত করা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার একটি প্রয়োজনীয় এবং ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। রকম সংকটের সময়ে খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সহজ নয়। এক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের সহায়তা দরকার। বিনিয়োগ করতে হবে নতুন পরিস্থিতিতে কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষ, যোগ্য মেধাবী জনবল তৈরিতেও। অবস্থায় সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং আর্থিক সামর্থ্যের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক এবং অংশীদারি পক্ষগুলোর কাছে স্বচ্ছ থাকা চাই।

বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের আর্থিক তথা ব্যাংক খাতও বর্তমান কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রয়াসে লিপ্ত। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পাশাপাশি আর্থিক এবং ব্যাংক খাতের সামর্থ্য উন্নয়নে ব্যবস্থা এবং নজরদারি বাড়িয়েছে। সত্ত্বেও মন্দঋণসহ কিছু দুর্বলতার দিক সময়টাতে প্রকট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এর মাঝেও গত পাঁচ দশকের ব্যাংক খাতের অগ্রযাত্রা অবদান আন্দাজ করার অবকাশ নেই, যা দেশের উন্নয়নে ব্যাংক খাতের প্রয়োজনীয়তা সংশ্লিষ্টতা নির্দেশ করে।

দীর্ঘ ৫০ বছরের যাত্রাপথে বাংলাদেশের আর্থিক খাত মুখোমুখি হয়েছে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের। তবে সময়ের মাঝে যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেছে দেশের আর্থিক খাত, পরিণত হয়েছে অনেক কার্যক্রম। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক ঝুঁকির বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত কয়েক বছরে ঋণ খাতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষত ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ব্যাসেল- এবং ব্যাসেল- বাস্তবায়ন এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আনয়নে বেশকিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংক খাতের বিভিন্ন সমস্যা ঝুঁকি মোকাবেলায় যেমন মানি লন্ডারিং জঙ্গি অর্থায়ন, করেসপনডেন্ট ব্যাংকিং-সংক্রান্ত সমস্যা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি কৌশল প্রণয়নে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ ব্যাংকিং কার্যক্রম তত্ত্বাবধান পরিবীক্ষণে গুণগত পরিবর্তন এনেছে। অনেক সমস্যার মাঝেও ব্যাংক খাতের উন্নয়ন সম্পৃক্ততা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রশংসার দাবিদার। আজকের ব্যাংক খাত অনেক বেশি ঝুঁকি বহন করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিছু ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রশংসনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কার্যক্রম সমাদৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। ধীরগতিতে হলেও পুঁজিবাজারে কর্মচাঞ্চল্য বাড়ছে। বীমা খাতে আস্থাপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তবে ব্যাংক খাতের ওপর দেশের অর্থনীতি, উদ্যোগ বাণিজ্যনির্ভরতা একেবারেই স্পষ্ট।

বর্তমান আগামী দিনের ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানবসম্পদ উন্নয়ন যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির বিকল্প নেই। একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অবশ্যই বাধা, উত্থান-পতন মন্দা আসবে। সময়কালই একটি নেতৃত্বের যোগ্যতার পরীক্ষার সময়। কার্যকরী নেতৃত্ব দক্ষ মানবসম্পদ এহেন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানকে সচল রেখে লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে, সার্বিকভাবে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত পরিবর্তন এসেছে। আর এর সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যাংকগুলোতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনতে হয়েছে। নীতিনির্ধারণী তথা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক খাতের নেতৃত্বের মধ্যেও সংগতিপূর্ণ পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। বর্তমান পরিস্থিতিকে সামনে রেখে ব্যাংক খাতের নেতৃত্ব তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুদক্ষ মানবসম্পদের সমন্বয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবেন, যা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী ভূমিকা পালনের সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তার সন্তুষ্টি শেয়ারহোল্ডারদের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হবে।

সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে, প্রতিযোগিতা বেড়েছে, নতুন নতুন আর্থিক পণ্য বাজারে এসেছে। তবে ক্ষেত্র ব্যাপ্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেমন নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি তৈরি হয়েছে অসংখ্য নতুন ধরনের ঝুঁকি। কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় এবং দক্ষতা বৃদ্ধি সব অংশীদারি পক্ষের সর্বজনীন লক্ষ্য। বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো মানবসম্পদ নিয়োগ পুনর্বণ্টনে মনোযোগ দিচ্ছে। কিছু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অধিকতর হারে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে সচেষ্ট হচ্ছে। বোধ হয় সবচেয়ে জোরেশোরে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আজকাল নৈতিকতা, পেশাগত সংস্কৃতি জবাবদিহির বিষয়গুলোকে বিধিমালা প্রণয়ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সন্নিবেশিত করছে। মূলত ভবিষ্যৎ মন্দা মোকাবেলা টেকসই আর্থিক খাতের তাগিদেই এমন পদক্ষেপ। নীতিপ্রণেতা এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার এরূপ চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে দক্ষ মানবসম্পদে বিনিয়োগ বর্তমানে ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসা কৌশল নির্ধারণে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

আর্থিক তথা ব্যাংক খাতে মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যাংক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীদারি পক্ষের আলোচনা-পর্যালোচনার ক্ষেত্র হিসেবে, বিআইবিএম আয়োজিত বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলন একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। বিআইবিএম নবমবারের মতো বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনের আয়োজন করছে আজ থেকে অর্থাৎ আগস্ট ২৭ থেকে। যথারীতি দুদিনের আয়োজনের উদ্বোধন করছেন বিআইবিএমের গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

আর্থিক খাতে টেকসই কার্যক্রমকে এবারের সম্মেলনের থিম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বর্তমান উন্নয়নের ধারা এবং পদ্ধতি যে পুরোপুরি টেকসই নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না, শুধু পরিবর্তিত পরিস্থিতি আবার তা অত্যন্ত জোরালো ভাষায় মানবজাতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। একটি উন্নয়নশীল দেশ তথা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, পরিবেশ উন্নয়ন এবং গ্রামীণ উন্নয়নের গুরুত্ব সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত। টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষেত্রগুলোকে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা যথেষ্ট গুরুত্ব অগ্রাধিকার দিয়ে আসছেন। তবুও নিম্নবিত্ত সাধারণ জনগণ এবং ছোট শিল্প ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এখনো পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ অন্যান্য সুবিধা যথেষ্ট পরিমাণে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের প্রচেষ্টায় এবং কিছু ব্যাংকের বিশেষ দক্ষতায় সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বারবার বিভিন্ন ধরনের মহামারী আমাদের উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করছে, শিক্ষা দিতে চেয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত বারবারই আমরা পরিবেশ প্রকৃতিকে বিপর্যয়ের মাঝে ঠেলে দিয়ে গতানুগতিক আধুনিকায়ন উন্নয়নের ধারায় মনোনিবেশ করেছি। সময় বলে দিচ্ছে, অর্থনীতির এই উন্নয়ন কৌশলে আদর্শ সঙ্গী করে নিতে হবে ব্যাংক তথা আর্থিক খাতকে, যা শুধু টেকসই আর্থিক সেবার বিস্তারে কাজ করবে। আমার বিশ্বাস, বিআইবিএমের বার্ষিক সম্মেলনের আলোচনায় টেকসই আর্থিক কার্যক্রম বিশেষ স্থান পাবে এবং বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভবিষ্যৎ পথচলায় তা যথাযথ ভূমিকা রাখবে।

 

. শাহ্ মো. আহসান হাবীব: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক বিআইবিএমের বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্স-২০২২-এর কার্যকরী কমিটির সভাপতি

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন