ব্যাংক খাতে নতুন চাপ বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ পরিশোধ

হাছান আদনান

রফতানি আয় নেই, এমন ব্যবসায়ীরাও দেদার ঋণ নিয়েছেন বিদেশী উৎস থেকে। কম সুদের প্রলোভনে নেয়া ঋণ এখন দেশের অনেক ব্যবসায়ীরই গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে। আবার ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার দায় বর্তাচ্ছে তহবিল জোগানদাতা ব্যাংকের ঘাড়ে। দেশের অনেক ব্যাংকই বিদেশী ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে খেলাপি হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ডলারের সংকট আর টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের প্রভাবে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, গ্যাস জ্বালানি তেল আমদানিতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে শুধু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই ৩৭৬ কোটি ডলারের দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ নিয়েছে। বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিলেও দেশের কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই রফতানি আয় নেই। কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বিপদ বাড়ছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, সরকার বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো থেকে কেনা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না। কারণে বড় একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির পক্ষ থেকে বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে দেয়ার জন্য আমাদের চাপ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি ডলার কিনতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত দরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত দর অনুযায়ী বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম ৯৫ টাকা। অথচ দামে আমরা বাজার থেকে ডলার কিনতে পারছি না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বেসরকারি খাতের কোম্পানির জন্য ডলার সরবরাহ করতে রাজি নয়। পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ কোম্পানিটির বিপদের পাশাপাশি ঋণ জোগানদাতা ব্যাংক হিসাবে আমরাও খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছি।

শুধু বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিই নয়, বরং রফতানি আয় নেই এমন অনেক শিল্প উদ্যোক্তাও বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ডলারের সংকট দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতির অজুহাতে বিদেশী ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করতে চাচ্ছেন। অবস্থায় অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে ঋণের অর্থ জোগানদাতা ব্যাংকগুলো বিপদে পড়েছে। আর বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে সরাসরি বিদেশী ঋণ নিয়ে আসা কোম্পানিগুলোও যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ করা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে।

গত পাঁচ বছরে বিদেশী উৎস থেকে সরকারি বেসরকারিউভয় খাতেই ঋণ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশী উৎস থেকে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন বা হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের মার্চ শেষে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৯৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ( হাজার ৩২৩ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশী মুদ্রায় ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় লাখ ৮৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২১ শতাংশ। বিপুল অংকের ঋণের ৭৩ শতাংশ সরকারের। বাকি ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাঁচ বছর আগে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ শেষে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন বা হাজার ৪৯৮ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকারও বেশি (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা দরে) বিপুল অংকের ঋণের অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার নেয়া হয়েছে করোনা মহামারীর দুই বছরে। ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর নেয়া বিদেশী ঋণের ৭০ শতাংশই স্বল্পমেয়াদি।

যেকোনো বিদেশী ঋণই যথাসময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে সেটি দেশের জন্য বিপদের কারণ হবে বলে মনে করেন ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, বেসরকারি যেসব কোম্পানির রফতানি আয় আছে, তাদের জন্য বিদেশী ঋণ পরিশোধ খুব বেশি সমস্যা হবে না। তবে যে কোম্পানিগুলোর রফতানি আয় নেই, তাদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশী ঋণ পরিশোধ কষ্টসাধ্য। স্বাভাবিক সময়ে বাজার থেকে ডলার কিনে ঋণ পরিশোধ করে দেয়া যায়। কিন্তু বর্তমান সময়টি অস্বাভাবিক। চাইলেই বাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করা যায় না। বাড়তি দামে ডলার সংগ্রহ করতে গেলে সেটিও ব্যাংকের পাশাপাশি ঋণগ্রহীতা কোম্পানির জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে যেকোনো উপায়ে যথাসময়ে বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় সেটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কারণ হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার বিদেশী ঋণের মধ্যে ৭৯১ কোটি ডলার ছিল দীর্ঘমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পাশাপাশি ট্রেড ক্রেডিট হিসেবে বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে। আর বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের হাজার ৭০৭ কোটি ডলারের মেয়াদ স্বল্প। ঋণের মধ্যে হাজার ১৭৮ কোটি ডলারের ধরন হলো ট্রেড ক্রেডিট। বায়ার ক্রেডিট, ডেফারড পেমেন্ট, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি হিসাবে এসব ঋণ নিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। এছাড়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ হিসেবে ৫২৯ কোটি ডলারের ঋণ বিদেশী উৎস থেকে নেয়া হয়েছে।

অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে দেশের বেসরকারি খাতে যেসব বিদেশী ঋণ এসেছে, তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বলে জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গ্রাহকরা বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলেও তহবিল জোগানদাতা ব্যাংককে সেটি পরিশোধ করে দিতে হবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবে। কারণে বিদেশী তহবিল সংগ্রহ এবং সেটির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। আবার যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রাহকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

দেশের বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি যে বিদেশী ঋণ এসেছে তার অর্ধেকই বিদ্যুৎ, গ্যাস জ্বালানি খাতে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৯১ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৩৭৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারই ছিল বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে। আর ২৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ এসেছে গ্যাস জ্বালানি খাতে। বিভিন্ন ধরনের উৎপাদনমুখী শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ এসেছে ১৪৪ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। এছাড়া নির্মাণ খাতে ২০ কোটি ৮১ লাখ ডলার, ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতের জন্য ব্যাংক এনবিএফআইগুলোতে ১৮০ কোটি ডলার, যানবাহন যোগাযোগ ব্যবস্থায় ৪১ কোটি ডলার এবং সেবা খাতে ৪৫ কোটি ডলারের বিদেশী ঋণ এসেছে।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার কারণে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১২ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালের আগস্টে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকার নিচে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত দর প্রতি ডলার ৯৫ টাকা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত দরে বাজারে ডলার পাওয়া যায় না। এখনো ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স হাউজগুলো থেকে ১১০ টাকার বেশি দরে ডলার কিনছে। দেশের খুচরা বাজারে প্রতি ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে সম্প্রতি তা কিছুটা কমে এসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন