এক-চতুর্থাংশ কিডনি রোগী চিকিৎসা নেন শেষ পর্যায়ে

ফিচার প্রতিবেদক

রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের ডায়ালাইসিস সেন্টারে রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন ছবি: কাজী সালাহউদ্দীন রাজু

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) দেহের রক্ত থেকে বর্জ্য পরিশোধন করতে না পারার অক্ষমতাকে বোঝায়। শরীরে রক্ত থেকে বর্জ্য বের করতে না পারায় শরীরিক নানা ধরনের জটিলতা দেখা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে অসুস্থতার কোনো উপসর্গ না থাকার কারণে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসছে শেষ পর্যায়ে। এতে কিডনি প্রতিস্থাপন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। একই সঙ্গে শেষ পর্যায়ে চিকিৎসা নেয়া হলে তাতে সফলতাও কমে যায় বলে জানিয়েছেন কিডনি বিশেষজ্ঞরা।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ কেন্দ্র বলছে, ডায়াবেটিস উচ্চরক্তচাপে আক্রান্তদের মধ্যে সিকেডির ঝুঁকি বেশি। একই সঙ্গে হূদরোগ, স্থূলতা, অটোইমিউন রোগ (স্বতঃঅনাক্রম্য রোগ) কিডনি রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে সিকেডির ঝুঁকি বাড়ে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব রোগে আক্রান্তদের মধ্যে কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ে। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের ফলে অনেক সময় কিডনি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়। নারীদের তুলনায় পুরুষদের কিডনি অকেজো হওয়ার সম্ভাবনা ৬৩ শতাংশ বেশি। কিডনি অকেজো হওয়া ব্যক্তির বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালাইসি বা কিডনি প্রতিস্থাপনের বিকল্প নেই।

বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্তদের এক-চতুর্থাংশ শেষ পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য আসছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পর্যালোচনা করে এমন তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। তারা বলছে, গত ১০ বছরে প্রায় ৩০ হাজার রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে ২২ শতাংশের বেশি এসেছিল পঞ্চম বা শেষ ধাপে। সময় তাদের কিডনি প্রতিস্থাপন অথবা ডায়ালাইসিস ছাড়া বাঁচানোর উপায় ছিল না।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রতন দাস গুপ্তা বণিক বার্তাকে বলেন, সিকেডির প্রথম পর্যায়ে সাধারণত কিডনি কার্যকারিতার কোনো সংকট তৈরি হয় না। কিডনি আকারে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। এরপর দ্বিতীয় তৃতীয় পর্যায়ে এসে কার্যকারিতার সমস্যা দেখা দেয়। তৃতীয় পর্যায় পর্যন্ত সাধারণত কিডনি রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। পরবর্তী সময়ে চতুর্থ পর্যায়ে এসে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। তবে তৃতীয় পর্যায় পর্যন্ত কোনো রোগীর কিডনি রোগ ধরা পড়লে তাকে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন থেকে বাঁচিয়ে আনা যায়। এছাড়া চতুর্থ পর্যায়ে এলেই তাকে ডায়ালাইসিসের আওতায় আনতে হয়। আর পঞ্চম পর্যায়ে রোগীর রোগ প্রতিকারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় না। তখন তার জন্য ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনই একমাত্র পথ খোলা থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন বলছে, বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার ১০ শতাংশ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি (সিকেডি) রোগে আক্রান্ত। ২০ লাখ মানুষ শুধু ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ পাচ্ছে। এদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ হেমোডায়ালাইসিস (বিশেষ ডায়ালাইসিস) করছে। তাদের ৬২ শতাংশই উচ্চ আয়ের দেশের নাগরিক। ডায়ালাইসিসের সুযোগ পাওয়াদের মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের বাসিন্দা। ২০ লাখের বেশি কিডনি রোগীর অকালে মৃত্যু হয় শুধু প্রয়োজনীয় সেবার অভাবে।

জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের তথ্য বলছে, দেশে কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে ভুগছে। প্রতি বছর ৩৫ থেকে ৪০ হাজার রোগী কিডনি রোগের শেষ পর্যায়ে উপনীত হচ্ছে। যাদের ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। দেশে ১৩০টি সরকারি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কিডনি রোগের জন্য ডায়ালাইসিসের সুবিধা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টিতে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। মোট ৬৫৮টি ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে দেশের এসব হাসপাতালে। ২০১৬ সাল থেকে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পুরোপুরি কিডনি অকেজো রোগীকে ডায়ালাইসিসের সেবা দেয়া হচ্ছে। দেশে প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে নেফ্রোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র একজন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের তথ্য বলছে, কিডনি রোগে আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুবিধার বাইরে থাকছে। দেশে প্রায় অর্ধশত বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে ডায়ালাইসিসের সুবিধা রয়েছে। এর ফি সরকার নির্ধারিত নয়। সরকারি হাসপাতালে কিছুটা কম হলেও বেসরকারিতে কয়েক গুণ বেশি। কিছু বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ফি হাজার টাকা থেকে শুরু। সর্বনিম্ন ব্যয়েও ডায়ালাইসিস করলে একজনের মাসিক খরচ দাঁড়ায় ২০-৩০ হাজারে। ফলে বেশির ভাগ দরিদ্র রোগী ডায়ালাইসিসের আওতায় আসে না।

কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস সুবিধা বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, ডায়ালাইসিস সুবিধা আগের থেকে বাড়ানো হয়েছে। বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ডায়ালাইসিস সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। আমাদের নেতৃত্বে কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনের কার্যক্রম চলছে।

দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগীদের চিকিৎসা এবং নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের চিকিৎসক ডা. শেখ মইনুল খোকন। তিনি বলেন, অসংক্রামক রোগে দীর্ঘ সময় ভোগা রোগী যাদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা কঠিন, তাদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা সময়ের দাবি। যদি স্বাস্থ্যবীমা মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু করা যায় তাহলে কিডনি রোগের কারণে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে ক্ষতি সেটি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ৪০ বছর আগে দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। সরকারিভাবে ৮টি বিভাগীয় শহরে কিডনি, ক্যান্সার কার্ডিয়াকের বিশেষায়িত চিকিৎসা শুরু করার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুয়ায়ী জীবন রক্ষায় নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেয়া যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন