সাকিবের পিপলস ব্যাংকের এলওআই বাতিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

তিন বছর আগে দেয়া পিপলস ব্যাংকের লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) বাতিল করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে গতকাল সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে পিপলস ব্যাংকের নামে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা এমএ কাশেম যে আবেদনটি করেছিলেন, সেটির কার্যকারিতা আর থাকল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান তার মা শিরিন আক্তার পিপলস ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে যুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকটির এলওআই বাতিলের সিদ্ধান্ত হওয়ায় আপাতত সাকিব আল হাসান ব্যাংকটির পরিচালক হতে পারছেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বিষয়ে বলেন, পিপলস ব্যাংককে দেয়া এলওআইয়ের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেছে। ব্যাংকটির পক্ষ থেকে আবারো মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের আবেদন পরিচালনা পর্ষদ আমলে নেয়নি। ফলে এমএ কাশেম নামের এক ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তিতে যে এলওআই ইস্যু করা হয়েছিল, সেটি বাতিল হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পিপলস ব্যাংকের নামে এলওআই ইস্যু করা হয়েছিল। ওই সময় ব্যাংকটির প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান এমএ কাশেমসহ উদ্যোক্তা ছিলেন ১২ জন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই ১২ জনের মধ্যে ১০ জনই বাদ পড়েছেন। এমএ কাশেমের আবেদনের ভিত্তিতে এলওআইয়ের মেয়াদ তিন দফায় বাড়ানো হয়েছিল। গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকটিতে মূলধন জমা দেয়ার জন্য ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছিল। তখন পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ছিল, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূলধন জমা দিতে ব্যর্থ হলে এলওআই বাতিল হয়ে যাবে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকটির উদ্যোক্তারা মূলধনের অর্থ জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন নতুন করে সাকিব আল হাসানসহ আরো ২১ জন উদ্যোক্তা ব্যাংকটিতে যুক্ত হয়েছেন। অবস্থায় আগের এলওআইয়ের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। ব্যাংক স্থাপনের জন্য জোগানকৃত মূলধন শতভাগ হোয়াইট মানি হতে হয়। পিপলস ব্যাংকের উদ্যোক্তা হিসেবে নতুন করে যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তাদের জোগানকৃত অর্থের উৎস যাচাই করতে হবে। এখন অন্য যে কেউ চাইলে পিপলস নামে ব্যাংক চেয়ে আবেদন করতে পারবেন। সেটি ক্রিকেটার সাকিব বা অন্য যে কেউ হতে পারেন।

২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের সভায় বেঙ্গল কমার্শিয়াল, সিটিজেনস পিপলস নামে নতুন তিনটি ব্যাংকের নীতিগত অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক গত বছরের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে। আর চূড়ান্ত লাইসেন্স পাওয়ার পর কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে সিটিজেনস ব্যাংক। কিন্তু এলওআই পাওয়ার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও পিপলস ব্যাংক এখনো লাইসেন্স নিতে পারেনি।

শুরুতে পিপলস ব্যাংক উদ্যোক্তাদের কয়েকজনের অর্থের উৎসে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটিকে দেয়া এলওআই স্থগিত করা হয়েছিল। বিতর্কিত উদ্যোক্তাদের বাদ দিলে পিপলস ব্যাংকের এলওআইয়ের ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূলধনের অর্থ জমা দিতে পারেনি ব্যাংকটি। শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এলওআইয়ের মেয়াদ ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তৃতীয় দফায় বর্ধিত ওই সময়েও ব্যাংকটি পরিশোধিত মূলধনের অর্থ জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

আগের উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগকে বাদ দিয়ে আবারো এলওআইয়ের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছিল পিপলস ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটির নতুন পরিচালক হিসেবে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান তার মা শিরিন আক্তারসহ বেশ কয়েকজনের নাম প্রস্তাব করা হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে সাকিব আল হাসান গত ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সময় সাকিবের সঙ্গে পিপলস ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তা এমএ কাশেমও গিয়েছিলেন। তারা ব্যাংকটির এলওআইয়ের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য গভর্নরের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ ডিসেম্বর এবার ব্যাংক মালিক হচ্ছেন সাকিব আল হাসান শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বণিক বার্তা। প্রতিবেদনে খেলার মাঠের বাইরে করপোরেট জগতে সাকিবের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রিকেট মাঠের মতোই দেশের করপোরেট জগতে অবস্থান শক্তিশালী করেছেন সাকিব আল হাসান। ব্রোকারেজ হাউজ স্বর্ণ আমদানি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের পর এবার দেশের ব্যাংক খাতে যুক্ত হচ্ছেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স প্রাপ্তির অপেক্ষায় থাকা পিপলস ব্যাংকের দুটি পরিচালক পদের মালিকানা যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টার বয়ের হাতে। সাকিব আল হাসানের পাশাপাশি তার মা শিরিন আক্তারও ব্যাংকটির পরিচালক হচ্ছেন। -সংক্রান্ত নথিপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে পিপলস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

দেশের সব ব্যাংকের প্রতি মূলধন ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সে হিসেবে বর্তমানে দেশে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে হলে সমপরিমাণ অর্থই মূলধন হিসেবে জমা রাখতে হবে। উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে হলে প্রয়োজন হয় সর্বনিম্ন শতাংশ শেয়ার ধারণের। সে হিসেবে পিপলস ব্যাংকের প্রতিটি পরিচালক পদের জন্য সর্বনিম্ন ১০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিতে হতো সাকিব আল হাসানকে। তবে ব্যাংকটির মালিকানায় আসতে তিনি প্রায় ৪০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিচ্ছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

পিপলস ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারী এমএ কাশেম যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাসিন্দা ব্যাংকের লাইসেন্স চেয়ে আবেদনের পর থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। পিপলস ব্যাংকের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে তিনি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। শুরুতে ব্যাংকটির উদ্যোক্তা হতে অনেকেই আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা জটিলতা জোগানকৃত অর্থের বৈধ উৎস দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের বেশির ভাগই ছিটকে পড়েছেন। শেষ পর্যন্ত সাকিব আল হাসান তার মা শিরিন আক্তার এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা পিপলস ব্যাংকের উদ্যোক্তা হিসেবে যুক্ত হন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন। ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা একটি এনআরবি ব্যাংকের প্রভাবশালী পরিচালকের স্ত্রীও পিপলস ব্যাংকের পরিচালকের তালিকায় ছিলেন।

প্রসঙ্গত, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসায়ী হিসেবে হাতেখড়ি সাকিব আল হাসানের। এরপর দ্রুতই নিজের ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন তিনি। স্বর্ণ আমদানি বিপণন, শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রসাধনী, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কাঁকড়া কুঁচের খামারসহ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে তার। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন তিনি।

তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে বছর দুয়েক ধরে দেশের পুঁজিবাজারের বড় প্রভাবক হয়ে ওঠেন সাকিব। পুঁজিবাজারে বড় অংকের অর্থ লগ্নি করেছেন তিনি। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শুভেচ্ছাদূত সাকিব আল হাসান গত বছরের মে মাসে একটি ব্রোকারেজ হাউজের অনুমোদনও পেয়েছেন। দেশে বৈধভাবে স্বর্ণবার স্বর্ণালংকার আমদানি এবং বিক্রির জন্য বুরাক কমোডিটিজ এক্সচেঞ্জ কোং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও নিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে ক্রিকেটের মাঠ ছাপিয়ে সাকিব আল হাসান করপোরেট জগতেরও বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন। তবে ব্যাট-বল হাতে সাকিবের যে সাফল্য, তা ধরা দেয়নি ব্যবসায়। দেশে তার বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই রুগ্ণ। কিছু প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে তিনি বিক্রিও করে দিয়েছেন। লোকসানের পাল্লা ভারী হওয়ায় বন্ধও হয়ে গেছে কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন