যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশ
কলোনি থেকে
স্বাধীন দেশ
হয়ে ওঠার
ঘোষণা দেয়
১৭৭৬ সালে।
দ্বিতীয় কন্টিনেন্টাল
কংগ্রেসের এ
ঘোষণা ছিল
আজকের মহাক্ষমতাধর
ও ধনী
দেশ মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার
প্রথম ধাপ।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক
শাসকদের যুদ্ধে
পরাজিত করে
স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র
পেয়েছিল আমেরিকানরা।
এ অর্জনে
রাজনীতিবিদ, সেনানায়কদের
সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা ছিল
দেশপ্রেমিক ধনীদের।
যুদ্ধের ময়দানে
নয়, দেশের
প্রতি তারা
আনুগত্য দেখিয়েছিলেন
নিজের অর্থবিত্ত
খরচ করে।
নিজের ভবিষ্যৎ
ক্ষতিগ্রস্ত করে
হলেও দেশের
সমৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার
দিয়েছিলেন এই
ধনীরা। তাদের
এ অবদানকে
ইতিহাস স্বীকৃতি
দিয়েছে ইকোনমিক
প্যাট্রিয়টিজম বা
অর্থনৈতিক স্বদেশপ্রেম
হিসেবে।
এ কালপর্বে
বোস্টন, চার্লসটন,
সাউথ ক্যারোলাইনা
ও অন্যান্য
মার্কিন শহরের
বেশ কয়েকজন
ধনী বণিক
সক্রিয়ভাবে অর্থনৈতিক
দেশপ্রেম দেখিয়েছিলেন।
আমেরিকার বিপ্লবের
সূচনাকারী ছিলেন
দেশটির শহরাঞ্চলের
শ্রমিক শ্রেণীর
মানুষ। বিশেষ
করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়
কলোনিগুলোর শ্রমজীবীরা
এক্ষেত্রে অগ্রণী
ভূমিকা রেখেছিলেন।
এরপর ধনী
বণিকদের সমর্থন
ও সহযোগিতায়
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে
আমেরিকান প্রতিরোধ
বিস্তৃত হয়,
তুঙ্গে ওঠে।
এর আগে
১৭৬৫ সালে
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের
চাপিয়ে দেয়া
স্ট্যাম্প অ্যাক্টের
বিরোধিতায় সক্রিয়
হয়েছিলেন মার্কিন
বণিকরা। কয়েক
বছর পর
ব্রিটিশদের সঙ্গে
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা
যুদ্ধ শুরু
হলে তাদের
অর্থনৈতিক দেশপ্রেম
আরো স্পষ্ট
হতে থাকে।
যুদ্ধের বিভিন্ন
ব্যয় মেটাতে
অর্থের জোগান
দিতে শুরু
করেন তারা।
জোসেফ ট্রামবুল,
থমাস মিফলিন
ও জেরেমিয়াহ
ওয়ার্ডসওর্থের মতো
বণিকদের সঞ্চিত
পুঁজি ব্যয়
হয় সেনাদের
রসদ সরবরাহ
স্বাভাবিক রাখার
কাজে।
এরপর ১৭৮০
সালের বসন্তে
আরেকবার স্বদেশপ্রেমের
পরীক্ষা দেন
আমেরিকান বণিকরা।
যুদ্ধের ময়দানে
তখন আমেরিকান
বাহিনীর অবস্থা
শোচনীয়। এ
লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র
আর এক
বছর টিকে
থাকবে কিনা
তা নিয়ে
সংশয় দেখা
দিয়েছিল। সাভান্না-জর্জিয়ার
পতন হয়েছে।
চার্লসটনও হাতছাড়া
হওয়ার দশা।
এমন সময়
এগিয়ে আসেন
ফিলাডেলফিয়ার ৯৭
জন ধনী
ব্যক্তি। রবার্ট
মরিস, থমাস
উইলিং, উইলিয়াম
বিংহ্যাম ও
আইনজীবী জেমস
উইলসনের নেতৃত্বে
তারা জড়ো
করলেন ৩
লাখ ১৫
হাজার পাউন্ড।
তখনকার হিসেবে
এটা বেশ
বড় অংকের
তহবিল। সে
সময় একজন
মার্কিন শ্রমিক
সারা জীবন
কাজ করে
আয় করতেন
৩ হাজার
২৫০ পাউন্ড।
বণিকদের এ
অর্থ খরচ
করে ক্রয়কৃত
রসদ দিয়ে
যুদ্ধের সবচেয়ে
সংকটপূর্ণ তিন
মাস পার
করেছিলেন মার্কিন
সৈনিকরা। এ
সহায়তা গোটা
যুদ্ধের মোড়
ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
গ্রেট
ব্রিটেনের সঙ্গে
আরেকবার যুক্তরাষ্ট্রের
যুদ্ধ শুরু
হয় ১৮১২
সালে। পরের
বছর যুদ্ধের
তীব্রতা বাড়ে।
সে বছর
যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি
অব ট্রেজারি
অ্যালবার্ট গ্যালাটিন
সেনাদের ব্যয়
মেটাতে ১
কোটি ৬০
লাখ ডলার
ঋণ বাজারে
বিক্রির চেষ্টা
করেন। ব্যবসায়ী
উইলিয়াম গ্রে
কয়েক লাখ
ডলারের ঋণ
কিনে অর্থের
জোগান দেন।
গ্যালাটিন সতর্ক
করেন যুদ্ধ
চালানোর মতো
অর্থ দ্রুতই
ফুরিয়ে আসছে।
এমন পরিস্থিতিতে
এগিয়ে আসেন
যুক্তরাষ্ট্রের তিন
ধনী নাগরিক—স্টিফেন
জিরার্ড, জন
জ্যাকব অ্যাস্টর
ও ডেভিড
পারিশ। গ্যালাটিন
তাদের রাজি
করান ঋণের
বাকি অংশ,
১ কোটি
ডলারের বেশি
কিনে নেয়ার
জন্য। এর
মাধ্যমে সরকার
যুদ্ধ চালানোর
মতো অর্থের
সংস্থান করতে
সমর্থ হয়।
শুধু যুদ্ধ
নয়, শান্তির
সময়েও দেশের
শিক্ষা খাত
ও অর্থনীতিকে
এগিয়ে নিতে
ভূমিকা রেখেছেন
যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদশালী
অনেক নাগরিক।
তাদের এ
অর্থনৈতিক স্বদেশপ্রেমেরই
ফসল আজকের
সুপারপাওয়ার মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের বর্তমান
অর্থনৈতিক সাফল্যের
পেছনে দেং
জিয়াও পিংয়ের
অর্থনৈতিক সংস্কারকে
কৃতিত্ব দেয়া
হয়। তিনি
ধনী চীন
নির্মাণের ভাবনা
সামনে নিয়ে
আসেন। ব্যক্তিকে
সুযোগ দেয়া
হয় অর্থনৈতিক
কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে
নিজের ভাগ্য
বদলের। একজন
উদ্যোক্তা যেমন
নিজের ভাগ্য
বদলাবেন, তেমনি
তার সঙ্গে
বদলে যাবে
চীনের অর্থনীতি,
সমাজও। মাও
সেতুং জমানায়
ব্যক্তিগত মুনাফা,
সম্পদ অর্জনকে
নিরুৎসাহিত করা
হয়েছিল। সেই
নৈতিক শৃঙ্খলকে
সরিয়ে দেং
জিয়াও পিং
অর্থনীতিকে উন্মুক্ত
করতে শুরু
করেন। অর্থনৈতিক
কর্মকাণ্ড ব্যক্তিজীবনে
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে
ওঠে। ব্যবসায়িক
সাফল্যে নায়কোচিত
সম্মান পেতে
শুরু করেন
উদ্যোক্তারা। ব্যক্তি
ও সমাজের
সমৃদ্ধির জন্য
কাজ করায়
তারা সামাজিক
পরিসরে সম্মানিত
হন। অগ্রগতির
সুবিধাভোগী হন
সাধারণ চীনা
নাগরিকরাও। ধনীদের
ধন-সম্পদ
বৃদ্ধির সঙ্গে
সঙ্গে নাগরিকদের
ভাগ্যে পরিবর্তন
আসে। বিশেষ
করে শহর
ও উপকূলীয়
এলাকার নাগরিকরা
উন্নত জীবনের
সুবিধা পেতে
শুরু করেন।
বৈশ্বিক পরিসরে
শক্তিশালী রাষ্ট্র
হিসেবে চীনের
উত্থান তাদের
গৌরবান্বিত করে।
তারা এর
সঙ্গে নিজেদের
সংযোগ খুঁজে
পান। উৎসাহী
হয়ে ওঠেন
নিজের দেশকে
আরো শক্তিশালী
অবস্থানে এগিয়ে
নিতে। এমন
প্রেরণা দেশটির
প্রযুক্তি খাতের
উন্নয়নে বড়
ভূমিকা রেখেছে।
নাগরিকদের এমন
মনোভাব ও
প্রয়াস চীনের
জাতীয় মানসে
দৃঢ় এবং
শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্রের
ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত
করেছে।
অর্থনৈতিক স্বদেশপ্রেম
নিয়ে আলোচনায়
জাপানকে কোনো
অবস্থাতেই বাদ
রাখা সম্ভব
নয়। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত
জাপানের অর্থনীতি
যেভাবে ঘুরে
দাঁড়িয়েছে তার
বড় কৃতিত্ব
দেশটির উদ্যোক্তাদের।
এশিয়ায় আধুনিক
শিল্পায়নের পথিকৃৎ
জাপান। দেশটির
উদ্যোক্তারা মনে
করেন কোনো
প্রতিষ্ঠান তৈরি
হয় মানুষের
কর্মসংস্থান নিশ্চিত
করতে। জাপানের
বিশ্বখ্যাত গ্রুপ
মিতসুবিশি প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন ইওয়াসাকি
ইয়াতারো। বলা
হয় উনিশ
শতকে জে
পি মর্গান
ও রকফেলার
মিলে যুক্তরাষ্ট্রের
জন্য যা
করেছেন জাপানের
জন্য তা
ইওয়াসাকি একাই
করেছেন। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর
জাপানে ভারী
ও রাসায়নিক
শিল্পের বিকাশে
মিতসুবিশি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন
করে। জাপানের
অর্থনীতি শক্তিশালী
হতে শুরু
করলে বেড়ে
যায় ব্যক্তিগত
গাড়ির চাহিদা,
যা পূরণ
করে টয়োটা।
আরেক বিখ্যাত
কোম্পানি সনির
যাত্রা ১৯৪৬
সালে। তাদের
লক্ষ্য ছিল
জাপানিদের উন্নত
প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক
পণ্য সরবরাহ
করা। টেলিভিশন,
মিউজিক প্লেয়ারের
মতো পণ্য
উৎপাদনের মাধ্যমে
তারা বদলে
দিয়েছিল জাপানের
সংস্কৃতি।
ভারতে বিদ্যুৎ
ব্যবহার করা
প্রথম হোটেলের
নাম তাজ।
টাটাদের এ
হোটেল ঔপনিবেশিক
আমল থেকে
মুম্বাইয়ের গর্ব।
ভারতের ভারী
শিল্প খাতে
নেতৃত্ব দিয়েছে
টাটা। ব্রিটেনের
একদা উপনিবেশ
ভারতবর্ষের এ
কোম্পানি এখন
খোদ ইংল্যান্ডের
বিখ্যাত দুই
ব্র্যান্ড জাগুয়ার
ও ল্যান্ড
রোভার কিনে
নিয়েছে। নিজেদের
মুনাফার সঙ্গে
সঙ্গে টাটা
গ্রুপ সচেতনভাবে
ভারতের আর্থসামাজিক
উন্নয়নে ভূমিকা
রেখেছে। এশিয়ার
প্রথম ক্যান্সার
হাসপাতাল তাদের
হাতে প্রতিষ্ঠিত
হয়। শিক্ষা
ও বৈজ্ঞানিক
গবেষণাকে এগিয়ে
নিতে টাটা
গ্রুপ ভারতে
বেশ কয়েকটি
গবেষণা প্রতিষ্ঠান
তৈরি করেছে।
দেড়শ বছরের
বেশি সময়
ধরে ভারতের
অর্থনীতিতে ভূমিকা
রাখছে আদিত্য
বিড়লা গ্রুপ।
বলা হয়
বিড়লা ভারতের
প্রথম ও
সবচেয়ে বড়
বহুজাতিক কনগ্লোমারেট।
ভারত স্বাধীন
হওয়ার পর
প্রতিষ্ঠিত হয়
আম্বানিদের রিলায়েন্স।
এ কোম্পানির
স্টিয়ারিং এখন
এশিয়ার শীর্ষ
ধনী মুকেশ
আম্বানির হাতে।
তিনি ভারতের
অর্থনীতিকে সামনের
৩০ বছরে
বিপুল রূপান্তরের
রূপকল্প হাজির
করেছেন। ভারতের
বিরাট বাজার
ও প্রযুক্তির
বিকাশের সম্ভাবনাকে
কাজে লাগানোর
ধারণাকে তিনি
সামনে এনেছেন।
নিজেদের দেশের
অর্থনীতি ও
নাগরিকদের জীবনমান
এগিয়ে নিতে
তাদের নিজস্ব
ভাবনা-দর্শন
আছে।
এত কিছু
বলার উদ্দেশ্য
আজকের বাংলাদেশকে
এমন অর্থনৈতিক
স্বদেশপ্রেমের প্রেক্ষাপটে
পর্যবেক্ষণ করা।
২০২১ সালে
আমরা বাংলাদেশের
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী
পালন করেছি।
এ মাইলফলকে
দাঁড়িয়ে উন্নয়ন,
সমৃদ্ধির অনেক
পরিসংখ্যান আমাদের
মনে আশা
জাগায়। জাতীয়
আয়ে উৎপাদন
খাতের অবদান
বৃদ্ধি, কর্মক্ষেত্রে
নারীর অগ্রগতি
ও নগরায়ণসহ
নানা সুবিধার
কারণে গোটা
দক্ষিণ এশিয়ায়
বিভিন্ন অর্থনৈতিক
সূচকে এগিয়ে
যাচ্ছে বাংলাদেশ।
গবেষণায় পাওয়া
তথ্যের ভিত্তিতে
ভারত ও
পাকিস্তানের সঙ্গে
তুলনামূলক বিশ্লেষণে
দেখা যাচ্ছে,
অর্থনৈতিক ও
আর্থসামাজিক ১৬টি
সূচকে ভারত
বাংলাদেশের চেয়ে
এগিয়ে রয়েছে
কেবল দুটি
সূচকে। বাকি
১৪টি সূচকে
ভারতকে পেছনে
ফেলেছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে ১৬টি
সূচকেই পাকিস্তানের
চেয়ে এগিয়ে
বাংলাদেশ।
কর্মক্ষেত্রে নারীর
উপস্থিতি বৃদ্ধি
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ও আর্থসামাজিক
উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখছে।
৯০-এর
দশকে বাংলাদেশে
কর্মসংস্থানে নারীর
উপস্থিতির হার
ছিল ২৪
দশমিক ৬৫
শতাংশ। এখন
তা বেড়ে
দাঁড়িয়েছে ৩৬
দশমিক ৩৭
শতাংশে।
দেশের অর্থনীতিতে
বড় পরিবর্তন
এনেছে উৎপাদনশীল
খাত। নব্বইয়ের
দশকে দেশের
মোট জিডিপিতে
উৎপাদনশীল খাতের
অবদান ছিল
১৩ দশমিক
২৪ শতাংশ,
যা এখন
বেড়ে হয়েছে
প্রায় ১৯
শতাংশ।
জনজীবন ও
অর্থনীতিতে এখনো
বড় ভূমিকা
রয়েছে কৃষির।
জমির পরিমাণ
না বাড়লেও
উৎপাদন বেড়েছে
খাতটিতে। এর
সঙ্গে সঙ্গে
বিকশিত হয়েছে
শিল্প খাত।
এক্ষেত্রে বেসরকারি
উদ্যোক্তারা নেতৃত্ব
দিয়েছেন। পুঁজি,
উদ্ভাবনী দক্ষতা,
ঝুঁকির সমন্বয়ে
তারা দেশের
শিল্প খাতকে
এগিয়ে নিয়েছেন।
দেশে মোট
বিনিয়োগের ৭০
শতাংশের বেশি
বেসরকারি খাতের।
তৈরি পোশাক,
চামড়া ও
চামড়াজাত, পাট
ও পাটজাত
পণ্য, কৃষিজাত
পণ্য, হোম
টেক্সটাইল, লাইট
ইঞ্জিনিয়ারিং, প্লাস্টিক,
ওষুধ ও
সিরামিক শিল্প
দেশের অর্থনীতিতে
বড় ভূমিকা
রাখছে। সাম্প্রতিক
সময়ে এসবের
সঙ্গে বিস্তৃত
হয়েছে সেবা
খাত। চলতি
দশকের শুরুতে
দেখা যাচ্ছে,
জিডিপিতে শিল্প
ও সেবা
খাতের অবদান
বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত এক
দশকে বিস্তৃত
হয়েছে অবকাঠামো,
বৈদেশিক বাণিজ্য,
পরিবহন, টেলিকম,
আর্থিক সেবা,
পর্যটন ও
স্বাস্থ্যসেবা খাত।
বিশেষভাবে নজর
দেয়া যায়
দেশের তৈরি
পোশাক খাতের
দিকে। প্রায়
৪৪ লাখ
মানুষের কর্মসংস্থান
তৈরি করেছে
খাতটি। শুধু
এ খাত
থেকে রফতানি
আয় হচ্ছে
৩২ বিলিয়ন
ডলারের বেশি,
যা দেশের
রফতানি আয়ের
প্রায় ৮৩
শতাংশ। এ
খাতকে এগিয়ে
নিতে নারী
শ্রমিকরা বড়
ভূমিকা রাখছেন।
কভিড মহামারীর
প্রাণঘাতী রূপও
তাদের ঘরে
বসিয়ে রাখতে
পারেনি। কর্মনিষ্ঠা,
পরিশ্রম ও
দক্ষতা দিয়ে
শিল্পটির তীব্র
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বাজারকে
বাংলাদেশের অনুকূলে
রেখেছেন তারা।
দেশে এখন
খালি চোখে
নগরায়ণের গতি
টের পাওয়া
যায়। ইন্টারনেট,
সড়ক যোগাযোগ
ব্যবস্থার উন্নতি
ও পণ্য
উৎপাদনের সক্ষমতা
বৃদ্ধি গ্রামগুলোয়
পৌঁছে দিয়েছে
নগরের নানা
সুবিধা। ৯০-এর
দশকে দেশে
নগরায়ণ হার
ছিল ১৯
দশমিক ৮১
শতাংশ। এখন
তা বেড়ে
হয়েছে ৩৪
দশমিক ১৭
শতাংশ।
বাংলাদেশের একটি
বড় রূপান্তর
ঘটেছে রেমিট্যান্সের
মাধ্যমে। গ্রামীণ
অবকাঠামো ও
জীবনযাত্রা বদলে
গেছে প্রবাসী
শ্রমিকদের পাঠানো
বৈদেশিক মুদ্রায়।
এ মানুষরা
সবাই দেশপ্রেমিক।
বাংলাদেশ ছাড়া
তাদের কোনো
ভবিষ্যৎ নেই।
দেশের ভবিষ্যতের
সঙ্গে তারা
সব সময়
জড়িয়ে থাকবেন।
এটা স্বাধীনতা-পরবর্তী
বাংলাদেশের মানুষের
স্বদেশপ্রেম। এ
দেশপ্রেমের কোনো
প্রতীক নেই।
বাংলাদেশের সমৃদ্ধিই
এর নিশান।
বিদেশের মাটিতে
কঠোর শ্রম
দিয়ে করা
রোজগার পাই
পাই করে
তারা দেশের
ঠিকানায় পাঠাচ্ছেন।
তাদের স্বপ্নের
জমা-পুঁজি
সব বাংলাদেশে।
দেশের বৈদেশিক
মুদ্রার রিজার্ভ
স্ফীত হচ্ছে
তাদের পাঠানো
রেমিট্যান্সে। অর্থনীতির
বড় শক্তি
হিসেবে কাজ
করছে এ
বৈদেশিক মুদ্রা।
প্রবাসীদের পাঠানো
রেমিট্যান্সে বদলে
গেছে দেশের
গ্রাম-মফস্বল।
জীবনযাত্রার সমৃদ্ধি
বা ইলেকট্রনিক
পণ্যসহ বিভিন্ন
সেবা খাতের
বিকাশে বড়
ভূমিকা রেখেছে
রেমিট্যান্স। খেটে
খাওয়া মানুষদের
এই অর্থনৈতিক
দেশপ্রেম শুধু
তাদের পরিবারের
মুখে হাসি
ফোটায়নি, বাংলাদেশকেও
এগিয়ে নিয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী
পালনের সময়
এসব সাফল্যের
পরিসংখ্যান আমাদের
আনন্দিত করে।
আমরা বাংলাদেশকে
বিশ্বদরবারে আরো
উঁচু আসনে
নেয়ার স্বপ্ন
দেখি। কিন্তু
অর্থনীতি ও
সমাজে এর
বিপরীত চিত্রও
রয়েছে। সেসব
চিত্র পর্যবেক্ষণ
করে বাংলাদেশের
বর্তমান ও
ভবিষ্যৎ নিয়ে
দুর্ভাবনা আমরা
এড়িয়ে যেতে
পারি না।
উন্নয়নের উল্টো
পিঠে দেখা
যায় সাধারণ
মানুষের নানা
দুর্ভোগ। দেশ
ও পরিবার
থেকে হাজার
মাইল দূরে
হাড়ভাঙা পরিশ্রম
করে রেমিট্যান্স
পাঠানো প্রবাসীদের
দেশের বিমানবন্দর
স্বাগত জানায়
হয়রানি আর
অপমানে। উচ্চশিক্ষা,
নিরাপদ ক্যারিয়ার
ও উন্নত
জীবনের খোঁজে
তরুণদের বিদেশ
গমন বাড়ছে।
তাদের একটি
বড় অংশ
বিদেশেই থেকে
যাচ্ছেন। জ্ঞানচর্চা,
উদ্ভাবনী দক্ষতায়
আমার পিছিয়ে
যাচ্ছি। আমাদের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বসেরাদের
ধারে-কাছে
থাকা দূরের
কথা, প্রতিবেশী
দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলোর
তুলনায়ও অনেক
পিছিয়ে। দেশে
নিয়মিত বিরতিতে
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
সেগুলোয় নতুন
নতুন ভবন
নির্মিত হচ্ছে।
কিন্তু এ
অবকাঠামো ও
সংখ্যাগত উন্নয়নের
বিপরীতে নামছে
শিক্ষার মানের
গ্রাফ।
আবার অর্থনীতির
সাফল্যগুলোকে পুরোপুরি
সন্তোষজনক বলা
চলে না।
২০১০ সালে
ডলারের স্থির
মূল্য ধরে
এডিবির পরিসংখ্যান
অনুযায়ী, ১৯৬০
সালে তত্কালীন
পূর্ব পাকিস্তানে
মাথাপিছু জিডিপির
পরিমাণ ছিল
৩৭২ ডলার।
২০১৮ সালে
বাংলাদেশে তা
বেড়ে দাঁড়ায়
১ হাজার
২০৩ ডলারে।
একই সময়ে
গোটা উন্নয়নশীল
এশিয়ার মাথাপিছু
জিডিপির পরিমাণ
৩৩০ ডলার
থেকে বেড়ে
দাঁড়িয়েছে ৪
হাজার ৯০৩
ডলারে।
আমাদের উন্নয়নের
বড় ভিত্তি
সস্তা শ্রম।
কিন্তু এ
সস্তা শ্রম
ও অদক্ষ
মানবসম্পদ দিয়ে
উন্নত দেশ
গঠন সম্ভব
নয়। এজন্য
দেশে বিশ্বমানের
শিক্ষা ও
গবেষণা প্রতিষ্ঠান
প্রয়োজন। সমান্তরালে
প্রয়োজন বিনিয়োগ।
দক্ষ কর্মশক্তি
ও বিনিয়োগ
নিশ্চিত করতে
পারে টেকসই
উন্নয়ন। আমরা
দেখি, যুক্তরাষ্ট্রের
হার্ভার্ড ও
স্ট্যানফোর্ডের মতো
বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
গড়ে উঠেছিল
ব্যক্তি উদ্যোগে।
সেই দেশের
ধনীরা এখনো
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে
নানাভাবে সহযোগিতা
করে যাচ্ছেন।
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে
লুণ্ঠন-বৈষম্য
কোনো নতুন
বৈশিষ্ট্য নয়।
কিন্তু আমরা
দেখি পুঁজিবাদী
উন্নত দেশগুলো
তাদের নাগরিকদের
জন্য নিরাপদ-মানবিক
জীবন নিশ্চিত
করেছে। এ
নিরাপদ জীবনের
হাতছানিতে দেশের
ধনীরা এখন
এসব দেশে
পাড়ি জমাচ্ছেন।
অথচ তাদের
বিনিয়োগ ও
উদ্যমের মিথষ্ক্রিয়া
বাংলাদেশের সমাজকে
যথেষ্ট বদলে
দিতে পারত।
কিন্তু সে
রকম কিছু
হয়নি, বরং
ঢাকা এখন
বিশ্বে বাসযোগ্যতার
নিরিখে সবচেয়ে
খারাপ অবস্থানে
থাকা শহরগুলোর
মধ্যে চতুর্থ।
ধনীরা তাদের
সন্তানকে মানসম্মত
শিক্ষা অর্জনের
জন্য পাঠাচ্ছেন
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে।
চিকিৎসা নেয়ার
জন্য উড়ে
যাচ্ছেন বিদেশের
হাসপাতালে। অনেকে
দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের
সাম্রাজ্য গড়ে
পরিবার নিয়ে
থিতু হচ্ছেন
কোনো উন্নত
দেশে। এ
ধনী উদ্যোক্তারা
দেশের রূপান্তরে
যে ভূমিকা
রাখতে পারতেন,
সমাজ এখন
তা থেকে
বঞ্চিত হচ্ছে।
তারা দেশে
বিভিন্ন নাগরিক
সেবার চাহিদা
তৈরি করলে
সেগুলো পূরণের
তাগাদাও তৈরি
হতো। উদ্যোক্তারা
এগিয়ে আসতেন
বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,
হাসপাতাল ইত্যাদি
নির্মাণে।
অতিধনীর সংখ্যা
বৃদ্ধির মাপকাঠিতে
বাংলাদেশ এখন
শীর্ষে। এমনকি
এদিক থেকে
চীন, যুক্তরাষ্ট্র,
ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড,
নিউজিল্যান্ডের মতো
দেশগুলোর চেয়েও
এগিয়ে বাংলাদেশ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা
প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স
কোম্পানির এক
গবেষণায় উঠে
এসেছে, ২০১২
থেকে ২০১৭
সালের মধ্যে
অন্তত ৩
কোটি ডলারের
সমপরিমাণ অর্থবিত্তের
মালিক বাংলাদেশী
অতিধনীর সংখ্যা
বেড়েছে ১৭
দশমিক ৩
শতাংশ। এ
সময় গোটা
পৃথিবীতে অতিধনীর
সংখ্যা বৃদ্ধির
দিক থেকে
বাংলাদেশ ছিল
শীর্ষস্থানে। একই
প্রতিষ্ঠানের আরেকটি
গবেষণায় দেখা
যায়, ২০১০
থেকে ২০১৯
সালের মধ্যে
কমপক্ষে ৫০
লাখ ডলারের
সমপরিমাণ অর্থবিত্তের
মালিকের সংখ্যাবৃদ্ধির
দিক থেকেও
বাংলাদেশ ছিল
শীর্ষস্থানে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক
সংস্থা গ্লোবাল
ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির
(জিএফআই) এক
প্রতিবেদনের তথ্য
অনুযায়ী, ২০০৯
থেকে ২০১৫
সাল পর্যন্ত
(২০১৪ সালের
হিসাব বাদে)
ছয় বছরে
বাংলাদেশ থেকে
৪ হাজার
৯৬৫ কোটি
ডলার পাচার
হয়েছে। ডলারপ্রতি
বিনিময় হার
৮৫ টাকা
ধরলে বাংলাদেশী
মুদ্রায় এর
পরিমাণ দাঁড়ায়
প্রায় ৪
লাখ ২২
হাজার কোটি
টাকা।
বাংলাদেশ স্বাধীন
না হলে
দেশের বিত্তশালী
গোষ্ঠীটির উত্থান
ছিল অসম্ভব।
এদের অনেকে
সম্পদ গড়েছেন
লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায়
যুক্ত হয়ে।
এখন পর্যন্ত
ব্যাংক থেকে
ঋণ নিয়ে
কতজন লাপাত্তা
হয়েছেন, তার
প্রকৃত হিসাব
পাওয়া শক্ত।
দেশ থেকে
লাপাত্তা হয়ে
তারা উদয়
হচ্ছেন উন্নত
কোনো দেশে।
সেখানে বিলাসবহুল
বাড়ি-গাড়ি
কিনছেন। দেশের
স্মৃতি পেছনে
রেখে পরিবার-পরিজনসহ
সেখানে স্থায়ী
হচ্ছেন তারা।
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর
সঙ্গে বিভিন্ন
সংযোগে যুক্তরা
বিপুল বিত্তের
মালিক হয়ে
যাচ্ছেন অল্প
সময়ে। আর
ধনী হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গেই
তারা তাকাচ্ছেন
দেশের সীমানার
বাইরে। তারা
বিদেশে আয়েশি-বিলাসী-নিরাপদ
জীবন নিশ্চিত
করতে দেশ
থেকে অর্থ
পাচার করছেন।
শুরুতে নিজে
না গেলেও
সন্তানকে বিদেশে
পাঠাচ্ছেন শিক্ষার
জন্য। সঙ্গে
পাঠিয়ে দিচ্ছেন
পরিবার।
ধনী ও
ক্ষমতাবানরা যদি
তাদের ভবিষ্যৎ
নিশ্চিত করেন
কোনো উন্নত
দেশে, তাহলে
নিজের দেশ
ও নাগরিকদের
উন্নয়ন নিয়ে
তাদের মাথা
ঘামানোর কথা
নয়। বাংলাদেশে
উন্নয়ন প্রকল্পের
গতিমুখ অনেক
সময় সাধারণ
মানুষের বিভিন্ন
সমস্যা সমাধানের
দিকে চালিত
হচ্ছে না।
বরং চোখ
ধাঁধানো অংকের
বাজেটের প্রকল্পগুলো
থেকে অনেকের
পকেট ভারী
হচ্ছে। দেশে
ভোগান্তি বাড়ছে।
আর টাকা
পাচার বাড়ছে
বিদেশে।
ধনীরা নিজ
দেশে বিনিয়োগ
না করলে
কোনো দেশ
মাথা তুলে
দাঁড়াতে পারে
না। বর্তমানে
বিশ্বের দুই
পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র
ও চীনের
উদাহরণ তা-ই
বলছে। শুধু
বিনিয়োগ নয়,
দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক
রূপান্তরেও তাদের
ভূমিকা থাকে।
ধনীরা নিজেদের
দেশকে হৃদয়ে ধারণ না
করলে উন্নয়ন
ব্যাহত হয়।
বাংলাদেশকে উন্নত
দেশের কাতারে
রূপান্তরের পথে
ধনী উদ্যোক্তাদের
বিদেশমুখী হওয়াটা
বড় ঝুঁকির
কারণ হয়ে
উঠতে পারে।
বাংলাদেশকে উন্নত
দেশের কাতারে
টেনে তুলতে
তাদের অর্থনৈতিক
স্বদেশপ্রেম অত্যন্ত
জরুরি।
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: সম্পাদক, বণিক বার্তা