মুডি’স-এর পর্যবেক্ষণ

বড় ঋণে কেন্দ্রীভূত ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো

একমত নন ব্যাংক নির্বাহীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

গত দুই দশকে দেশে সাধারণ ধারার ব্যাংকের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকিংয়ের। সময়ে বাজারে ইসলামী ধারার নতুন ব্যাংক আসার পাশাপাশি সাধারণ ধারার প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকও ইসলামী ধারায় রূপান্তর হয়েছে। দ্রুতগতিতে বেড়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর আমানত বিনিয়োগসহ আর্থিক অবয়ব। তবে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান মুডি বলছে, বাংলাদেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর সম্পদের ঝুঁকি সাধারণ ধারার ব্যাংকের চেয়ে বেশি। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ক্রমেই করপোরেট ঋণে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ ধারার ব্যাংকের তুলনায় ইসলামী ধারার ব্যাংকের মূলধন সক্ষমতা, তহবিল ব্যবস্থাপনা মুনাফা পরিস্থিতিও দুর্বল।

যদিও মুডিসের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মোটেই একমত নন ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা। তারা বলছেন, ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানটির পর্যবেক্ষণ ইসলামী ধারার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাংকের ক্ষেত্রে সত্য হতে পারে। কিন্তু পুরো ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে ঢালাওভাবে মুডি যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, সেটি প্রকৃত সত্যের বিপরীত।

চলতি বছরের আগস্টের তথ্যের ভিত্তিতে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং সম্পর্কে পর্যবেক্ষণটি দিয়েছে মুডিস। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। মুডি বলছে, পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ৫২ শতাংশ ছিল করপোরেট খাতে। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে ধারার ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশই করপোরেট খাতে চলে গেছে। যদিও গত পাঁচ বছরে সাধারণ ধারার ব্যাংকগুলো করপোরেট খাতে ঋণ বিতরণ কমিয়েছে। ২০১৬ সালে সাধারণ ধারার ব্যাংকগুলোর করপোরেট খাতে ঋণ ছিল ৭৫ শতাংশ। বর্তমানে ধারার ব্যাংকগুলোর করপোরেট ঋণ ৭১ শতাংশে নেমে এসেছে।

ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য হলো, চলমান মহামারীর মধ্যে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত মান উন্নত হয়েছে। তবে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর তুলনায় ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর সম্পদের ঝুঁকি বেশি বেড়েছে। কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য হলো সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো দ্রুত বিনিয়োগ বা ঋণ বাড়িয়েছে। করপোরেট ঋণ বাড়ানোয় প্রচলিত ধারার ব্যাংকের তুলনায় ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ক্ষতি মোকাবেলার সক্ষমতা কম।

তবে মুডিসের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত নন শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মুডি একটি আন্তর্জাতিক রেটিং প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির মন্তব্য বা গবেষণাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এমন একটি প্রতিষ্ঠান কোনো দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে মন্তব্য করার আগে আরো বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। প্রতিষ্ঠানটির ভুল মন্তব্য বাংলাদেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে।

শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, সম্পদের গুণগত মান, তহবিল ব্যবস্থাপনা, মূলধন কাঠামো মুনাফার দিক থেকে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান খুবই সুদৃঢ়। আমাদের ব্যাংকের কস্ট অব ডিপোজিট সাড়ে শতাংশের নিচে। দেশের প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে হাতেগোনা দু-চারটির তহবিল ব্যয় আমাদের চেয়ে কম। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরেই আমরা এসএমই রিটেইল খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। মুহূর্তে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ স্থিতির ৩৬ শতাংশই এসএমই খাতে। আমাদের ক্যাপিটাল অ্যাডিকেসি রেশিও (সিএআর) প্রায় ১৪ শতাংশ। মূলধন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমরা ৫০০ কোটি টাকার পারপিচুয়াল বন্ডের অনুমোদন পেয়েছি। এরই মধ্যে ৩৭৫ কোটি টাকার বন্ডের সাবক্রিপশন হয়ে গেছে। বন্ডের অর্থ যোগ হলে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের মূলধন সক্ষমতা আরো বাড়বে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের হাত ধরে আশির দশকে বাংলাদেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকিংয়ের সূচনা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ইসলামী ধারার ব্যাংক ১০টি। ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। সম্প্রতি নতুন করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ধারার ব্যাংকে রূপান্তর হয়েছে। এছাড়া সাধারণ ধারার ব্যাংকগুলোও ইসলামী উইন্ডো শাখা চালুর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।

চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। আমানতের মধ্যে লাখ ৬৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকাই ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর। সে হিসেবে মোট ব্যাংক আমানতের ২৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ ধারার ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণে। একই সময়ে দেশের মোট ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৯০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। ঋণের মধ্যে লাখ ২৭ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে। এছাড়া দেশের মোট রেমিট্যান্সের ৩৩ শতাংশ আসছে ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাও মনে করছেন, বাংলাদেশের ইসলামী ধারার ব্যাংক নিয়ে করা মুডিসের পর্যবেক্ষণ পুরোপুরি সঠিক নয়। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, এসএমই খাতে দেশের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী ব্যাংক হলো ইসলামী ব্যাংক। গত কয়েক বছর ধরে আমরা করপোরেট খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিবর্তে কমিয়েছি। দুবছর আগেও করপোরেট খাতে আমাদের বিনিয়োগ ছিল ৫২ শতাংশের বেশি। বর্তমানে করপোরেটে বিনিয়োগ ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। রিটেইল, কৃষি ভোক্তা ঋণকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা বিনিয়োগ বাড়াচ্ছি। আমাদের মূলধন সক্ষমতা ব্যাসল--এর মানদণ্ডের চেয়ে বেশি আছে। তার পরও আমরা ৮০০ কোটি টাকার পারপিচুয়াল বন্ড ছাড়তে যাচ্ছি। মুডিসের পর্যবেক্ষণটি ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

মুডিসের পর্যবেক্ষণ হলো, গালফ করপোরেশন কাউন্সিল গত কয়েক বছর ধরে রিটেইল ব্যবসায় মনোযোগী হচ্ছে। অথচ সময়ে বাংলাদেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো অনেক বেশি করপোরেট ঋণে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বিশেষ করে বড় করপোরেটগুলোতে বেশি মাত্রায় ধারার ব্যাংকগুলোর ঋণ বেশি যাচ্ছে। করপোরেট খাতে নতুন করে যুক্ত হওয়া এবং অর্থ গ্রহণকারীদের তা ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি।

ইসলামী ধারার ব্যাংকের মুনাফা ব্যবস্থা তুলনামূলক দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেছে মুডিস। সম্পর্কে প্রতিষ্ঠার ভাষ্য হলো, ইসলামী ধারার ব্যাংকের তহবিল ব্যয় প্রচলিত ধারার ব্যাংকের তুলনায় বেশি। খরুচে মেয়াদি আমানতের কারণে ধারার ব্যাংকের মুনাফা পরিস্থিতি দুর্বল। কারণে মূলধন বাড়ানোর ক্ষেত্রেও ইসলামী ধারার ব্যাংক পিছিয়ে পড়ে। অথচ ইসলামিক অর্থায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এর ফলে ইসলামিক ব্যাংক এবং মূলধারার ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ মূলধন তৈরির ক্ষেত্রে ফারাক ক্রমাগত বাড়বে।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অন্তত শতাংশ লেভারেজ রেশিও রাখা প্রয়োজন উল্লেখ করে মুডি বলছে, ২০২০ সাল শেষে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল অ্যাডিকেসি রেশিও ছিল ১২ দশমিক শতাংশ, যেখানে সাধারণ ধারার ব্যাংকের ছিল ১৪ শতাংশ। দশমিক শতাংশ ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার রেখে ইসলামী ধারার ব্যাংকসহ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অন্তত ১২ দশমিক শতাংশ ক্যাপিটাল অ্যাডিকেসি রেশিও রাখা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকের লেভারেজ রেশিও ২০২০ সালে দশমিক শতাংশ ছিল, যেখানে সাধারণ ধারার ব্যাংকের ছিল দশমিক শতাংশ।

তবে করপোরেট নয়, বরং সিএসএমই কৃষি খাতে বিনিয়োগে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) জোর দিচ্ছে বলে জানান ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ওসমান আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ২০১৭ সাল থেকে আমি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। শুরু থেকেই আমি এসএমই কৃষি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোকে অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। অতীতের তুলনায় এসআইবিএলের বিনিয়োগে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে। রিটেইল খাতে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা বিনিয়োগ পণ্য সাজিয়েছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন