তথ্যপ্রযুক্তি

ডিজিটাল রূপান্তরে গড়তে হবে দক্ষ জনশক্তি

ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান

অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, খাদ্যাভাব ইত্যাদি সমস্যা কাটিয়ে উঠে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ ৫০ বছরে আজ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল এবং মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। গত বছর সারা বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর উন্নত দেশগুলো যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, তখনো থেমে থাকেনি দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। নতুন স্বাভাবিকতায় এগিয়ে যাওয়ার তাগিদে দেশের শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বেশির ভাগ কার্যক্রম স্থানান্তর হয়েছে অনলাইনে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে প্রত্যয় নিয়ে দেশ অগ্রসর হচ্ছে, বৈশ্বিক মহামারী তা ত্বরান্বিত করেছে এবং আমরা অত্যন্ত কম সময়ের ভেতর বিভিন্ন খাতে দ্রুতগতিতে ডিজিটাল রূপান্তর ঘটতে দেখছি এবং এর সুফল ভোগ করতে শুরু করেছি। দেশের সব খাতের ডিজিটাল রূপান্তর ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কিংবা করোনা-পরবর্তী সময়ে সার্বিক পুনরুদ্ধার একেবারেই অসম্ভব। ডিজিটাল রূপান্তরের ধারা অব্যাহত না থাকলে দেশ খুব কম সময়ে অনেকখানি পিছিয়ে যাবে। সরকার তাই ডিজিটাল রূপান্তর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারকে কাজে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে চলেছে। দেশে কভিড-১৯ প্রকোপ বৃদ্ধির পর ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিভিন্ন সেবা চালু হওয়ায় মানুষের জীবন যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি প্রায় সব অফিশিয়াল কাজ অনলাইনে স্থানান্তর হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক কাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

করোনা অতিমারী চলাকালীন টেলিমেডিসিন খাতের বিকাশ দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের ডিজিটালাইজেশনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। মানুষ দিনকে দিন অনলাইন কেনাকাটায় বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতানুগতিক ধারায় পরিবর্তন এসেছে এবং দেশের -কমার্স খাতের প্রসার ঘটেছে। টেলিকম, ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যাংকিং খাতে ডিজিটাল সেবার গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। আর তাই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইআরপি সিস্টেম, পেমেন্ট পদ্ধতি, বিগ ডাটা অ্যানালিটিকসের মতো ডিজিটাল সমাধান গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এছাড়া শিক্ষা খাতকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনার প্রয়াসে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিক্ষার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সম্প্রতি ডিজিটাল কনটেন্ট কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। উদ্যোগের মাধ্যমে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের ডিজিটাল রূপান্তরের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে ইন্টারনেটের ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা। এছাড়া, দেশের ৯৮ ভাগ এলাকা টেলিকম নেটওয়ার্কের আওতায় আসার পাশাপাশি ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ হচ্ছে। তবে শুধু ইন্টারনেটের বিস্তৃতিই নয়, ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, ডাটার সঠিক ব্যবহার, ডিজিটাল টুল, যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সাধারণ জনগণের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি।

অধিক জনসংখ্যা যেকোনো দেশের জন্য বেশ বড় চ্যালেঞ্জ হলেও আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হতে পারে এই বিশাল জনসম্পদ। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ দেশে এখন নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর চেয়ে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেশি। আগামী ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে জনসম্পদকে মেধাসম্পদে পরিণত করতে না পারলে তা পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিকভাবেই দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দক্ষ জনবলের অভাব দেশের অর্থনীতির জন্যও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

আমরা যদি প্রতিবেশী দেশ ভারত অথবা ফিলিপাইনের সঙ্গে তুলনা করি, তবে বলতে হয় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প সেই তুলনায় ছোট হলেও অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এর বিকাশ ঘটছে এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ মানসম্মত জনবল সংকট এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা খাতের সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাবে দেশের আইটি ফার্মগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে কাজ করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। দেশের মোট শ্রমশক্তির মাত্র শূন্য দশমিক শতাংশ মানুষ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সারা বিশ্বে যখন পুরোদমে ডিজিটাল বিপ্লব চলছে এবং দেশ ডিজিটাল রূপান্তরের পথে হাঁটছে, তখন সংখ্যা নেহাতই কম বলা চলে।

এছাড়া প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা মডেলে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করছে এবং এতে চাকরির বাজারে ঘটছে আমূল পরিবর্তন; যারা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাদের অনেকেই চাকরি হারাচ্ছেন। আবার অনেক প্রযুক্তি খাতে দক্ষ ব্যক্তি সহজেই কাজ পেতে সক্ষম হচ্ছে কিংবা ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে মাসে বেশ ভালো আয় করতে সক্ষম হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে স্নাতক সম্পন্ন করা কর্মীর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং প্রোগ্রামার, সিস্টেম অ্যানালিস্ট, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স স্পেশালিস্টের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী পর্যাপ্ত জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে বিশেষত তরুণসমাজকে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে। তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি দূর করার লক্ষ্যে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করতে হবে। হুয়াওয়ের সিডস ফর দ্য ফিউচার-এর মতো প্রোগ্রামের মাধ্যমে তরুণ শিক্ষার্থীদের একাডেমিক জ্ঞান শিল্প খাতের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা যেতে পারে। এতে তারা নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে, যা তাদের অদূরবর্তী কর্মক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়তা করবে। ডিজিটাল রূপান্তর শুধু সম্ভাবনাই উন্মোচন করবে না, অনেক খাতের টেকসই উন্নয়ন ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়ও বটে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী কয়েক বছরে দেশে আরো উন্নত ডিজিটাল কানেক্টিভিটি বিকাশ লাভ করবে এবং দেশের সর্বত্র মোবাইল কমিউনিকেশনে ফাইভজি নিশ্চিত করা হবে। তাই দ্রুততার সঙ্গে সব ক্ষেত্রকে ডিজিটালবান্ধব করে তুলতে পারলে দেশের উত্তরণের পথ সহজতর হবে। আর এজন্য সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের মানুষকে প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষিত করে একটি দক্ষ জনবলসম্পন্ন ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা অতিজরুরি। 

 

. মো. মোস্তাফিজুর রহমান: অধ্যাপক, ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, খুলনা প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন