প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ যাচ্ছে পুঁজিবাজারে

অপব্যবহার বন্ধে নজরদারি বাড়াক ব্যাংক

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে দেশে চলছে করোনার প্রকোপ। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নেয়া লকডাউন, বিধিনিষেধে অর্থনীতি ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। বড় থেকে ছোট অনেক শিল্প-কারখানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হয়েছে আর্থিক দুর্যোগ। করোনাসৃষ্ট বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সরকার এখন পর্যন্ত ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্যাকেজের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া হচ্ছে স্বল্প সুদে ঋণ। শর্ত অনুযায়ী প্রাপ্ত ঋণের অর্থ প্রতিষ্ঠানের চলতি মূলধন হিসেবে ব্যয় হওয়ার কথা। দুঃখজনকভাবে শর্ত ভঙ্গ করে অনেক অর্থ চলে যাচ্ছে ভিন্ন খাতে। এটা স্পষ্টতই অপব্যবহার অনিয়ম বৈকি। বিশেষ এক পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সচল রাখতে দেয়া হচ্ছে প্রণোদনার অর্থ। এর অপব্যবহার কোনোভাবেই কাম্য নয়।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকার চলমান মহামারীর শুরু থেকেই সচেষ্ট। দেশের বড়, মাঝারি ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সংগত কারণে দ্রুতই আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপত্কালীন অর্থ প্রদানে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণের অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সার্বিকভাবে বিষয়টি তদারক করছে। সঠিক গ্রাহক যেন প্রণোদনার ঋণ পান, প্রকৃত খাতে যেন ব্যয় হয়, তার জন্য নানা শর্ত আরোপ করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে সুস্পষ্ট নীতিমালা। অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে ব্যাংকগুলোকে একাধিকবার নির্দেশনাও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। উদ্দেশ্য, প্রকৃত খাতে ব্যয় হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায় এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রণোদনা প্যাকেজের অপব্যবহার অনেকাংশে রোধ করা যাচ্ছে না। প্রণোদনা ঋণের অর্থ দিয়ে কোনো কোনো গ্রাহক জমি-বাড়ি, কেউ কেউ গাড়ি কিনছেন। আর বড় একটা অংশ পুঁজিবাজারে লগ্নি করা হচ্ছে বলে খবর মিলছে। এটা নিয়মের লঙ্ঘন যেমন, তেমনি অনৈতিকও বটে। মূলত ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকের গাফিলতির কারণে এমনটি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের মত। কাজেই প্রণোদনার অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই।

শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের উন্নত উন্নয়নশীল অনেক দেশেই করোনার অভিঘাত মোকাবেলায় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে আপত্কালীন টিকে থাকতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকায়ও ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কোথাও অপব্যবহারের তথ্য মেলেনি। ওইসব দেশের উদ্যোক্তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা কাজে লাগাচ্ছেন। প্রকৃত খাতে ব্যয় করছেন। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ যেমন ব্যাপারে বেশ সক্রিয়, তেমনি উদ্যোক্তারাও সতর্ক। শর্তের ফাঁকফোকর এড়ানোরও খুব একটা সুযোগ নেই। ফলে সেখানে প্রণোদনা প্যাকেজগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাংলাদেশে তার উল্টো চিত্র। এখানে কোনো গ্রাহক প্রণোদনার অর্থ প্রথমে চলতি মূলধনে বিনিয়োগ হিসেবে দেখিয়ে পরবর্তী সময়ে সরিয়ে অন্যত্র ব্যয়ের বিষয় উঠে এসেছে কারো কারো ভাষ্যে। বিদ্যমান অবস্থায় ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হলে বিধিগতভাবে ধরার সুযোগ নেই। সুতরাং শর্তগুলো পুনর্বিবেচনা আরো কৌশলী, সুচিন্তিত করার দাবি রাখে, যাতে অপব্যবহারের ন্যূনতম সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অন্য দেশের নীতি এবং ঋণ অনুমোদন, বিতরণ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ব্যবহার পর্যন্ত পুরো নজরদারি কাঠামো পর্যালোচনা করে জুতসই পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

এখন স্বাভাবিক সময় নয়। বিরাজ করছে জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি। এর প্রভাব সর্বব্যাপ্ত। বিশেষ সময়ে শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য উজ্জীবিত রাখতে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। দেশের উদ্যোক্তাদের পরিত্রাণে দিচ্ছে সাশ্রয়ী হারে ঋণ। এটা তাদের জন্য বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা বৈকি। এতে তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হচ্ছেন। কাজেই প্রণোদনার ঋণের অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়টাও তাদের বেশি। কিন্তু কোনো কোনো গ্রাহক শর্ত ভঙ্গ করে যেভাবে এর অপব্যবহার করছেন, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। প্রণোদনা থেকে প্রত্যক্ষভাবে যেহেতু উদ্যোক্তারা লাভবান হচ্ছেন, তাই নিজ গরজেই তাদের অপব্যবহারের অনৈতিক প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।

বলা হচ্ছে, বৃহৎ শিল্প সেবা খাতের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থের অপব্যবহার হচ্ছে বেশি। কিছু ক্ষেত্রে সিএসএমই খাতের প্যাকেজেও এমনটা ঘটছে, যা মোটেই কাম্য নয়। গত বছর প্যাকেজ ঘোষণাকালে প্রধানমন্ত্রী এর যেন কোনো অপব্যবহার না হয়, সে ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। সবাইকে সততার সঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবু কোনো কোনো গ্রাহক যে সুযোগের অপব্যবহার করছেন, তা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যেরই প্রতিফলন। এটা বন্ধ করতে হবে। ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকগুলোর কাছে কাদের হাতে ঋণের অর্থ পৌঁছেছে সে তালিকা আছে। ওই তালিকা ধরে কারা কোথায় অর্থ ব্যয় করছেন, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে শর্ত ভঙ্গ করলে প্রণোদনা প্রত্যাহারের মতো কঠোর ব্যবস্থাও নেয়া যেতে পারে।

ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে বর্তমানে অসম অবস্থা বিরাজমান। অর্থপ্রাপ্তিতে বড়রা এগিয়ে, ছোটরা এখনো পিছিয়ে। অবস্থায় যারা আগে পাচ্ছেন, তারা নিশ্চয়ই ভাগ্যবান। এই এগিয়ে থাকাদের মধ্যে যদি কেউ অর্থের অপব্যবহার করেন, সেটি হতাশাজনক। সন্দেহ নেই, অর্থ প্রকৃত অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত অন্য কোনো উদ্যোক্তাকে দেয়া হলে তার জন্য ভালো হতো। এতে সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। কিন্তু অপব্যবহারের ফলে প্রণোদনার প্রকৃত উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। তাই এটা রোধ করা জরুরি। প্রণোদনার ঋণ কয়েক দফায় বিতরণ করা হচ্ছে। যেহেতু অপব্যবহারের তথ্য মিলছে, সেহেতু ব্যাংকগুলোকে গ্রাহক চিহ্নিত করা, ঋণ অনুমোদন, বিতরণ ব্যবহার নিশ্চিতের ব্যাপারে আরো সতর্ক হতে হবে। যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। বাড়াতে হবে তদারকি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন