জাতিসংঘের যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা ২০২১

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে বাস্তবায়ন হোক

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে জাতিসংঘের গৃহীত যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা (জেআরপি) ২০২১ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে আজ। বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে আগস্ট ২০১৭ থেকে মানবিক সহায়তাকারী সাড়াদানের মাধ্যমে হাজারো জীবন বেঁচেছে। এ সহায়তা অব্যাহত রাখতে সুরক্ষা কাঠামোর মধ্য থেকে বিভিন্ন খাতে মানবিক সহায়তা চালিয়ে যেতে যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা ২০২১ প্রণয়ন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়েদের সুরক্ষা বৃদ্ধি, যাদের সহায়তা প্রয়োজন তাদের মানসম্পন্ন জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদান, উখিয়া ও টেকনাফে জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও মিয়ানমারে টেকসই সমাধান অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করা। অস্বীকারের উপায় নেই, মানবিক সহায়তাকারী সাড়াদানের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে সুরক্ষা ও সহায়তা দিতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিকে আরো কার্যকরভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ উপযোগ নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরো সতর্ক ও তদারকি জোরদার করা আবশ্যক। অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয়ে কীভাবে আরো স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে।

১৯৭৮ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু নির্যাতনের কারণে বড় আকারে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ২০১৭ সালে। রোহিঙ্গারা জানিয়েছে তারা বাড়ি ফিরে যেতে প্রস্তুত, তবে শুধু তখনই যখন তা নিরাপদ হবে। তারা মৌলিক অধিকার ও সেবার নিশ্চয়তা চায় এবং মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পাওয়ার একটা পথ চায়। এ সংকটের সমাধান নির্ভর করে মিয়ানমারের ওপর। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেন স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে এবং টেকসইভাবে ফিরে যেতে পারে, সে রকম একটি পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে কাজ করতে হবে। এখন পর্যন্ত সাড়াদানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রচেষ্টা, দাতাদের অবদান ও যুক্ততা এবং সরকার ও মানবিক সহায়তাকারী অংশীদারদের কার্যক্রমের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে পরিকল্পনার শতভাগ অর্জন সম্ভব হয়নি কিছু দুর্বলতার কারণে। এবারে সেগুলোর উপস্থিতি কাম্য নয়।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর ভরণপোষণের ভার বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বহন করবে, তা প্রত্যাশা করা যায় না। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায়তাও প্রয়োজন। প্রত্যাবর্তন না হওয়া পর্যন্ত কিছু অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার কথাও আলোচনায় আসছে, যেমন ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানব পাচার রোধ করা, ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে তাদের উৎসাহিত করা, দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে রোহিঙ্গাদের প্রস্তুত করা, সব রোহিঙ্গার জন্য আইডি কার্ডের বিধান করা এবং পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা। আবার এটিও মনে রাখা প্রয়োজন যে, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ অবস্থানের ফলে নানা রকম আর্থসামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হওয়ায় শিবিরে রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা ও বঞ্চনা বেড়ে চলেছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে জনসংখ্যাগত যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে পারস্পরিক অসন্তোষ, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও দৃশ্যমান হচ্ছে। এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী একটি আবদ্ধ স্থানে কর্মহীন অবস্থায় বসবাস করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশাও লক্ষ করা যাচ্ছে। অধিকন্তু রোহিঙ্গাদের অবস্থান আরো দীর্ঘায়িত হলে তা বাংলাদেশের জন্য একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করবে বলে অনেকের আশঙ্কা। যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনায় এসব বিষয়ও বিবেচনায় নিতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকটের প্রভাব দীর্ঘ, তাই স্বল্প সময়ের জন্য নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে স্থানীয় অংশগ্রহণ না থাকলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হবে না। রোহিঙ্গা কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত সব সংস্থার কক্সবাজারের পরিবেশ পুনরুদ্ধার ও স্থানীয়করণের পরিকল্পনা প্রকাশের উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গা কর্মসূচির জন্য কোনটি প্রয়োজনীয় আর কোনটি বিলাসিতা, সেটা চিহ্নিত এবং অপচয় রোধ করে অর্থের সদ্ব্যবহার করতে হবে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন গুরুত্ব দিতে হবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমারকে বাধ্য করার বিষয়ে। পাশাপাশি যত দিন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থাকবে ততদিন তাদের মৌলিক অধিকার পূরণেও সচেষ্ট থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় এনজিও ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার সঙ্গে সরকারের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সম্পদের সদ্ব্যবহার ও কাজের সুফল নিশ্চিতে এটি দূর করা আবশ্যক। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো কী পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করছে, কোন খাতে তা খরচ করছে, তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা উচিত। বর্তমানে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় একাধিক কর্তৃপক্ষ আছে, যেমন আইএসসিজি, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরসিসি) ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। কর্মসূচি ও তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য একটি একক কর্তৃপক্ষ ও একক তহবিল ব্যবস্থাপনা থাকলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে তিনটি সংস্থার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্থানীয় বাংলাদেশীদের চাহিদা মেটাতে ও জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার এবং মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ২০২১-এর জেআরপিতে সেই ইস্যুগুলোকে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, যেসব কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের জন্য সেবামূলক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, টেকসই জীবিকার সুযোগ, জ্বালানিবিষয়ক কর্মকাণ্ড এবং পরিবেশ পুনর্গঠনের ওপর জোর দিতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকট চতুর্থ বছরে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশের বিস্তৃত ও টেকসই আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার। পাশাপাশি যারা বছরের পর বছর আশ্রয় দিয়ে আসছে, সেই বাংলাদেশীদের পাশেও বিশ্বকে দাঁড়াতে হবে। আর জটিল এ সংকটকে আরো জটিল করে তুলেছে কভিড-১৯ মহামারী, যা শরণার্থী ও আশ্রয়দাতা সম্প্রদায় উভয়কে আরো ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এ কথা সত্য, একটি সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ অনেক জীবন রক্ষা করেছে, যদিও সব ধরনের মানবিক সহায়তা ও নিরাপত্তা সেবা অব্যাহত রাখার কাজটি সহজ নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী ও আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের চাহিদা পূরণের জন্য ২০২০ সালের জেআরপিতে যে অর্থ জাতিসংঘ চেয়েছিল তা পাওয়া যায়নি। এটি উদ্দেশ্য অর্জনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। ২০২১-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থ পেতে তাই আরো জোর প্রচারণা চালাতে হবে। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছামূলক, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য অবশ্যই মনোযোগ ধরে রাখতে হবে, যাতে পরিস্থিতি অনুকূল হলে কাজ শুরু করা যায়। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ঘিরে চলমান সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জটিলতার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। ২০২১ সালের জেআরপি বাস্তবায়নে তাই স্থানীয়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহ ও তার বণ্টন-ব্যবহারে আরো স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন