‘হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমাকে পাঞ্জাবি দাওনি কেন?’

কভিড মহামারী বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন। জীবন-জীবিকা সবখানেই আঘাত হেনেছে এ দুর্যোগ। ঈদ উৎসবেও পিছু ছাড়ছে না মহামারী। উৎসব মানেই বহু মানুষের একত্র উদযাপন। আর করোনাভাইরাস বাধ্য করছে দূরত্ব বজায় রাখতে। এমন সময়ে দেশের বেশ কয়েকজন তারকা শিল্পীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের ঈদের পরিকল্পনা বিষয়ে। কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন তাদের ঈদের অনেক স্মৃতিও। তারকাদের সঙ্গে কথা বলেছেন মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ

আরিফিন শুভ

এবার ঈদ গত ঈদের মতোই কাটবে। সারা দিন বাড়িতে থাকব। শুধু ঈদে না, অন্যান্য দিনেও বের হতে পারি না। এগুলো ভাবলেই মন খারাপ লাগে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় কেনাকাটার মনমানসিকতা নেই। 

আমার চলচ্চিত্রজীবনের সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজ ‘মিশন এক্সট্রিম’। এখন পর্যন্ত কোনো কাজে আমি এত পরিশ্রম করিনি। সিনেমাটা গত ঈদে আসার কথা ছিল। মহামারীর কারণে আসতে পারল না। এবার ঈদেও হলো না। এ সিনেমাটা এখনো মুক্তি দেয়া গেল না। এটা নিয়ে বেশ দুঃখ আছে মনে। এখন আর ঈদের জন্য অপেক্ষা না, করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে ছবিটা মুক্তি পাবে।

আমার ছোটবেলা কেটেছে ময়মনসিংহে। ছোটবেলার ঈদের দিন রিকশায় করে ঘোরাটা খুব মিস করি, কাজিনরা মিলে, বন্ধুরা মিলে। সকালবেলা খাবার খেয়ে রিকশায় বের হতাম। খুব মজা হতো। সেই দিনগুলো প্রচণ্ড মিস করি। ব্রহ্মপুত্র পাড়ে যাওয়াটাই ছিল ঈদের প্রধান আকর্ষণ। ঈদে জামাকাপড় পরে, সেজেগুজে, বুড়া-বাচ্চা, ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে চলে যেতাম নদীর পাড়ে। সারা দিন ধরে ঘুরে বেড়াতাম নদীর পাড়ে। এখন ওই জায়গাগুলো কমার্শিয়াল হয়ে গেছে। আগের সেই অনুভূতিটা কাজ করে না। 

ফারুক আহমেদ

এবারের ঈদকে আমি মোটেও ব্যতিক্রম ঈদ বলব না। গত বছরও একইভাবে কেটেছে। ভবিষ্যতে কতদিন এভাবে ঈদ করতে হয় তার কি ঠিক আছে? হতে পারে এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তখন করোনা চলে গেলে সবাই মিলে যদি ঈদ করতে পারি সেটাই হবে ব্যতিক্রম ঈদ। এবার ঈদে কিছুই করব না। বাসায় থাকব। শপিং করিনি। 

ঈদে ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে গ্রামে যেতাম। সে সময়ের ঈদ আমাকে খুব নস্টালজিক করে দেয়। রোজার পুরো এক মাস ছুটি থাকত। ঈদ হতো আমাদের মাঠে। দুই-আড়াইশ মানুষ, সবাই সবাইকে চেনে। সবাই সবার সঙ্গে কোলাকুলি করত। এখন ঢাকা শহরে নামাজ পড়ে চলে আসতে হয়। কেউ কারো পরিচিত না। গ্রামের সেই ঈদে একজন না এলেও ঈদের নামাজ শুরু হতো না। 

আগে প্রতি ঈদের আগের দিন হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে দেখা করতাম। আমি তাকে মেরুন রঙের পাঞ্জাবি উপহার দিতাম। আমার পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজ পড়তেন। এবার আমি দেশের বাইরে ঈদ করেছি। পাঞ্জাবি আর দিতে পারিনি। তার এক বছর পর ঈদের নাটকের শুটিং করছি। শট দিচ্ছিলাম, এমন সময় হুমায়ূন স্যার আমাকে তার রুমে ডাকলেন। বললেন, বসো। বসলাম। হঠাত্ করে রাগ হয়ে গেল তার। বললেন, তুমি গত ঈদে আমাকে পাঞ্জাবি দাওনি কেন? আমি অবাক হয়ে গেলাম। এক বছর আগের ঘটনা এখনো মনে আছে? তিনি তো আমাকে ধমকানো শুরু করলেন। আমি বললাম, দেশে ছিলাম না। আরো জোরে ধমক দিয়ে বললেন, তোমার ড্রাইভার তো দেশে ছিল। তাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে। পাশে শাওন ছিল। সে বলল, আপনি ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে এমন করছেন কেন? বাদ দেন না? হুমায়ূন আহমেদ নাছোড়বান্দা। বললেন, ও পাঞ্জাবি দিল না কেন আমাকে? আমি ওর পাঞ্জাবি পরে ঈদ করি। আমার খুবই খারাপ লাগল। বললাম, যেহেতু দিইনি। এখন কী আর করা। আগামী ঈদে দেব। তিনি আরো রেগে গেলেন। বললেন, নো। তোমার পাঞ্জাবি আমি আর পরব না। তুমি আমাকে পাঞ্জাবি দেবে না। খবরদার আমাকে কোনো পাঞ্জাবিটাঞ্জাবি দেবে না। আমি মহা বিপদে পড়ে গেলাম। কী করি? কিছুতেই বোঝাতে পারি না। শাওন বলল, তুমি যাও। চলে এলাম। আবার ঈদের আগের দিন ঠিকই পাঞ্জাবি নিয়ে তার বাসায় গেছি। ওনার বাসার দরজা সব সময় খোলাই থাকত। বেল দিলে বের হয়ে আসতেন। আমি বেল বাজালাম। স্যার বের হয়ে এলেন। আমাকে দেখে বললেন, আরে ফারুক, কী ব্যাপার? বললাম, স্যার আপনার জন্য পাঞ্জাবি, বাচ্চাদের জন্য জামাকাপড় আর শাওনের জন্য শাড়ি এনেছি। স্যার আগের মতোই মহাখুশি। আগের সেই ঘটনা তার একটুও মনে নেই। বললেন, ‘তাই নাকি? শাওন দেখো ফারুক কত কিছু নিয়ে আসছে আমাদের জন্য। আসো আসো ভেতরে আসো।’ সেসব দিনগুলো খুব মিস করি।

শাহনাজ খুশি

এবার ঈদের কোনো পরিকল্পনা নেই। সুস্থ থাকা, ঘরে থাকা, পরিবারের ও নিজের সুস্থতা ছাড়া আর কোনো পরিকল্পনা নেই এবার ঈদে। শপিংয়ে যাইনি। বাজার-সদাইও করিনি। কেননা সুপার শপগুলোতে প্রচণ্ড ভিড়। বাচ্চাদের রান্না করে খাওয়াতে গেলেও অনেক জিনিস কম পড়বে। তার পরও এবার বাইরে যাইনি। আর দশটা বন্দি দিনের মতোই ঈদের দিন কাটবে। ছোটবেলায় ঈদ শব্দের মধ্যে আনন্দে বিলীন হওয়ার একটা ব্যাপার ছিল। ঈদের আগের রাতে ঘুমাতে পারতাম না। সবাই মিলে সেহরি খাওয়ার সময়েই জেগে উঠতাম। রাস্তায় গিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। সাবান নিয়ে নদীতে গোসল করতে চলে যেতাম। ঈদে খুব কম সালামি পেতাম। তার পরও সালামির এ পর্বটা ছিল খুবই আনন্দের। দোয়েল পাখির ছবিওয়ালা ২ টাকার নোট, হরিণের ছবিওয়ালা ১ টাকার নোট। সালামির টাকা গুছিয়ে ম্যাটিনি শো দেখতে বড় ভাইয়ের সঙ্গে সিনেমা হলে যেতাম। সারা দিন এত হইচই করতাম যে সন্ধ্যার আগেই ঘুমিয়ে যেতাম। 

সংসারজীবনে আসার পর বাচ্চাদের নিয়ে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করা হয়। এখন তো নাটক লিখি। নাটকে অভিনয় করি। সেগুলো ঈদে মুক্তি পায়। এবার ঈদেও আমার বেশ কয়েকটি নাটক আছে। ঈদের নাটক অনেক আগে থেকে বানানো শুরু হয়। আমাদের ঈদ শুরু হয় তিন-চার মাস আগেই। এর ফাঁকে দু-একদিন গ্যাপ পেলে কেনাকাটা করি। সবার জন্য কেনা হয়। গত তিনটা ঈদে শপিংয়ে যাইনি। আমি দেশের জন্য যেহেতু অন্য কোনো অবদান রাখতে পারছি না। আমার জন্য যেন একজন মানুষও আক্রান্ত না হয়, আমি যেন হাসপাতালের একটা বেডও দখল করে না রাখি, এটা আমার চেষ্টা। 

আঁখি আলমগীর

এবার ঈদে কোনো পরিকল্পনাই নেই। আগের ঈদ অনেক আনন্দের ছিল। ঈদের আগে কেনাকাটা করতাম। ইদের দিন খাওয়াদাওয়া করতাম। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। ঘুরতে যেতাম। টিভি প্রোগ্রাম থাকত। স্টেজ শো থাকত। সেগুলো করতাম। অ্যালবাম রিলিজ হতো। সেসব নিয়ে এক্সাইটমেন্টে থাকতাম মাসব্যাপী। এক-দুই মাস ধরে চলত। তারপর বোঝা যেত গান মানুষের ভালো লাগছে কিনা। এখন তো ইউটিউব এসে গেছে। এক-দুদিনেই বোঝা যায় কী হবে? ফলে সেই এক্সাইটমেন্টটা কাজ করে না। সেই সময়গুলোকে প্রচণ্ড মিস করি। আগে মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করেছি। পরিবারের সঙ্গে দেশের বাইরে ঈদ করেছি। ঈদের আলাদা একটা আমেজ ছিল। আমাদের ঈদগুলো আনন্দময় ছিল। এখন সেসব আর নেই।

সোহানা সাবা

এবার কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। বাসায়ই কাটাব। হয়তো ঢাকার বাইরে কোথাও যেতে পারি। আগে সারা বছর কাজ করতাম। ঈদে পরিবারকে সময় দিতাম। দেড় বছর ধরে পরিবারকেই সময় দিচ্ছি। টুকটাক কাজ করলেও বলা চলে দেড় বছর ছুটিই কাটালাম। ফলে আলাদা করে পরিবারকে সময় দেয়ার কিছু নেই এবার। মায়ের হাতের রান্নাবান্না খাওয়া হবে। 

আমরা এক ভাই এক বোন। আগের ঈদে সাতদিনে সাত রকম জামাকাপড়, তার সঙ্গে ম্যাচিং করে অন্য সবকিছু পরতাম। ছোটবেলা থেকেই আমি এসব বিষয়ে খুব খেয়াল রাখতাম। দেখা যেত আমার চাহিদা পূরণ করতেই সবাই ব্যস্ত থাকত। আমার ভাইয়ের দিকে খুব একটা নজর দেয়ার সময় পেত না। বড় হওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতাম। স্কুলফ্রেন্ডদের সঙ্গে হইচই করতাম। ঈদের সময় যেহেতু রাস্তা ফাঁকা থাকত, আমরা তিন-চারজন এক রিকশায় উঠে অন্য রিকশার সঙ্গে রেস খেলতাম। মজার সব সময় কাটাতাম। 


পূজা চেরি

আমার ছোটবেলার ঈদ আর এখনকার ঈদে খুব বেশি পার্থক্য নেই। আমি তো ছোটবেলা থেকেই অভিনয় করি। তবে আগে সবাই চিনত শিশুশিল্পী হিসেবে, এখন চেনে নায়িকা হিসেবে। করোনা আসার আগে ঈদে বন্ধুদের বাসায় যেতাম। বন্ধুরা আমার বাসায় আসত। তিনটা ঈদ আমরা মহামারীর মধ্যেই কাটাচ্ছি। মহামারীর কারণে অনেক কিছুই করতে পারছি না। এবার ঈদে ‘শান’ নামে আমার একটা সিনেমা মুক্তির কথা ছিল। ঈদের মতো উৎসবে সিনেমা রিলিজ হওয়া বড় একটা ব্যাপার। মহামারী না থাকলে আরো অনেকগুলো সিনেমা মুক্তি পেত। অনেক সিনেমার সঙ্গে আমার সিনেমা মুক্তি পাওয়া আরো বড় বিষয়। এ বিষয়টা ভেবে খুব মন খারাপ লাগছে। অনেকেই শান সিনেমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাদের অপেক্ষা দীর্ঘ হলো। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় সিনেমা এখন মুক্তি না পাওয়াই ভালো। 

পোড়ামন-২ সিনেমাটা ঈদে মুক্তি পায়। একে তো প্রথম সিনেমা। সেটা মুক্তি পেল ঈদে। প্রথম সিনেমার অনুভূতিই আলাদা। আমরা সিনেমার প্রমোশনে পুরো টিম সারা দেশে ঘুরেছি। খুব আনন্দের ঈদ ছিল সেটা। এখন করোনার কারণে মনে হয় না সেভাবে প্রমোশন করা যাবে। আমি চাই আগের সেই দিনগুলো দ্রুত ফিরে আসুক। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন