খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণে শম্বুকগতি

দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্যই বিমানবন্দরটি দ্রুত নির্মাণ করা হোক

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিপুল বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকলেও যথাযথ রাষ্ট্রীয় নীতি মনোযোগের অভাবে নিকট অতীতে সেটিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়নি। বিশেষ করে দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর মোংলার অবস্থান সত্ত্বেও একই কারণে অঞ্চলটিতে নিশ্চিত হয়নি কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক সচলতা। তবে জাতীয় অর্থনীতিতে অঞ্চলটির অবদান লক্ষণীয় মাত্রায় বাড়াতে বর্তমান সরকার বিপুল কর্মযজ্ঞের আয়োজন করেছে। হাতে নিয়েছে মোংলা বন্দরের বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম, মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। উল্লিখিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে নিঃসন্দেহে অঞ্চলটির রূপান্তরমূলক পরিবর্তন সূচিত হবে। কিন্তু রাজধানীসহ দেশের অন্য অংশের সঙ্গে সহজ নিরবচ্ছিন্ন  যোগাযোগহীনতার কারণে গৃহীত উদ্যোগগুলোর সুফল নিয়ে শঙ্কা বিরাজমান। স্বভাবতই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের পাশাপাশি বাগেরহাটের রামপালে খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়। প্রাথমিকভাবে ছোট বিমানবন্দরের লক্ষ্য থাকলেও ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী এটিকে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর করার ঘোষণা দেন। অথচ প্রতিশ্রুতির প্রায় এক দশক পেরোলেও শুরু করা যায়নি মূল প্রকল্পের কাজ। অগ্রগতি এখনো জমি গ্রহণ সীমানাপ্রাচীর নির্মাণেই সীমাবদ্ধ।

বলা হয়েছিল, চলতি বছর জুন নাগাদ বিমানবন্দরটির নির্মাণকাজ শেষ হবে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, অর্থায়ন অনিশ্চয়তায় তা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পটি সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা থাকলেও মুনাফাযোগ্যতা বিবেচনায় বেসরকারি খাত এক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে অর্থের সংস্থান হচ্ছে না। এভাবে আর চলতে পারে না। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজে গতিসঞ্চার এবং নতুন নির্ধারিত সময়ে তা সম্পন্ন করার জন্য কীভাবে অর্থায়ন নিশ্চিত করা যায়, তার উপায় খুঁজতে হবে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এবং বঙ্গোপসাগরের মত্স্য সম্পদ, বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত পাট, দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা, চিংড়ি কাঁকড়াসহ হিমায়িত খাদ্য রফতানি, ইপিজেড, দেশের ৭ম টেস্ট ভেন্যু শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম, হার্ডবোর্ড নিউজপ্রিন্ট মিলসহ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল, দেশের উপকূলের সবচেয়ে গভীর এলাকা সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড ইত্যাদি রয়েছে। এক সময়ের সমৃদ্ধ খুলনা আজ অনেকটাই অবহেলিত। পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের একটি হিসেবে এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। পদ্মা সেতু তৈরি, মোংলা বন্দরকে সক্রিয় করার মাধ্যমে অঞ্চলের অর্থনীতিকে গতিশীল করার চেষ্টা চলছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল বিভাগে বিমানবন্দর থাকলেও তৃতীয় বৃহৎ নগরী হিসেবে খুলনায় বিমানবন্দর না থাকাটা হতাশাজনক। আশার কথা হলো, ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণে নেয়া উদ্যোগগুলো ঘিরে এরই মধ্যে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাদের সামনে বড় প্রতিবন্ধক হলো, দ্রুততম সময়ে বিনিয়োগ গন্তব্যে পৌঁছানো। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে মাত্র একটি বিমানবন্দরই রয়েছে। তাও যশোরে অবস্থিত। সেখান থেকে মোংলা বা খুলনায় যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগে। এটি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে খানজাহান আলী বিমানবন্দরটি হলে স্বল্প সময়ে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। তাদের ভোগান্তি ঝামেলার অনেকাংশেই নিরসন হবে। সেদিক থেকে বিমানবন্দরটি যথাসম্ভব দ্রুত সম্পন্ন হওয়াটাই সমীচীন। 

বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাগেরহাট শহর, মোংলা বন্দর বিভাগীয় শহর খুলনার সঙ্গে ২৫ মিনিটের সমদূরত্বে নির্মিত হচ্ছে বিমানবন্দরটি। বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ শেষ হলে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনের ইকো ট্যুরিজম, হযরত খান জাহানের মাজার ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ষাটগম্বুজ মসজিদের পর্যটন শিল্পের দ্রুত বিকাশ, মোংলা বন্দর, ইপিজেড, রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, চিংড়ি শিল্প বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বাড়ানোসহ নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর পাশাপাশি অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বৈকি। বলা যায়, যত দ্রুত বিমানবন্দরটি সম্পন্ন হবে, অর্থনৈতিক লাভের দৃষ্টিকোণ থেকে অঞ্চলটির প্রতি ততই বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বাড়বে। 

দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত বিমানবন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আশা বিপুল। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, খুলনা-মোংলা মহাসড়কের পাশে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করার বিষয়টি মাথায় রেখে বিমানবন্দরের কাজ শুরু শেষ করা  প্রয়োজন। মোংলা বন্দরকে গতিশীল করার জন্যও বিমানবন্দরটি জরুরি। স্বাভাবিকভাবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এটি নিয়ে এক ধরনের জনচাপের মুখে রয়েছে। তারা মনে করছেন, পিপিপির পরিবর্তে রাজস্ব খাতের অধীনে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হলে বিমানবন্দরটির কাজ অনেক গতিশীল হতো। এমনও হতে পারত যে এতদিনে এটি পুরোপুরি সচল হয়েছে। সুতরাং নির্মাণকাজে বিলম্বের জন্য তাদেরও একটা দায় থেকে যায়। তারা যদি বিমানবন্দরটির প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বোঝাতে সক্ষম হতেন, তাহলে ধরনের অর্থায়ন অনিশ্চয়তায় পড়তে হতো না। এখন বিষয়টি আমলে নিয়ে তাদেরও বিশেষ সক্রিয়তা দরকার। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে বিদেশী উৎস থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করা যায় কিনা, সেটি ভাবনা-চিন্তা করা যেতে পারে।

সাম্প্রতিক এক বৈঠকে অবশ্য আলোচ্য বিমানবন্দরের অর্থায়নের জন্য চূড়ান্তভাবে পিপিপির মাধ্যমেই এগোনোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বিনিয়োগকারী আকর্ষণে নতুন করে প্রস্তাব তৈরির খবরও মিলছে। সংশ্লিষ্টদের তত্পরতায় অর্থায়ন অনিশ্চয়তা দূর হয়ে দ্রুত বিমানবন্দরটি বাস্তবে রূপ লাভ করবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন