দুই নারীর প্রভাবে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে আইএমএফ?

বণিক বার্তা ডেস্ক

সম্প্রতি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টেলিনা জর্জিয়েভা প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথের এক যৌথ নিবন্ধ প্রকাশ হয়। নিবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল চলমান কভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ধস মোকাবেলায় দেশগুলোর করণীয়। 

নিবন্ধে বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, মহামারীর ক্ষতিগ্রস্ত ছোট-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মূলধনি সহায়তা দানের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে উচ্চমাত্রায় করপোরেট কর পরিশোধের শর্তে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি মূলধন বা ঋণ সরবরাহ করা যেতে পারে। একই শর্তে অনুদান দেয়া যেতে পারে ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। এছাড়া ভর্তুকির মাধ্যমে মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি তাদের উপযুক্ত খাতে কর্মসংস্থান নিশ্চিতের জন্য নতুন করে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে কর্মীদের ঘরে বসে কার্যক্রম চালাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপরও জোর দেয়া হয় নিবন্ধে।

আইএমএফের দুই শীর্ষ ব্যক্তির কাছ থেকে ধরনের বক্তব্য আসার বিষয়টি কিছুটা আশ্চর্যজনকও বটে। কারণ ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর প্রতি আইএমএফের যেসব শর্ত থাকে তার অন্যতম হলো সরকার পতনের আশঙ্কায় থাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়াত্বের হাত থেকে সুরক্ষা দিতে কোনোভাবেই এগিয়ে আসতে পারবে না। এছাড়া ঋণগ্রহীতা সরকারগুলোর কৃচ্ছ্রসাধনে বাধ্য করার বিষয়েও অনেক দুর্নাম রয়েছে সংস্থাটির। কৃচ্ছ্রসাধনের খাঁড়ায় কাটা পড়ে সরকারের ভর্তুকিনির্ভর কার্যক্রম। কারণে ঋণদাতা সংস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাপী খুব একটা জনপ্রিয় নয় আইএমএফ।  

কারণেই সংস্থার দুই শীর্ষ নির্বাহীর কাছ থেকে ধরনের বক্তব্যে নতুন প্রশ্নের অবকাশ তৈরি হচ্ছে, আইএমএফ কি তবে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে?

ধরনের প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ অতীতে আইএমএফের কারণে ঋণগ্রহীতা দেশগুলো নানাভাবে বিপাকে পড়ার পাশাপাশি দেশে দেশে বহু লোকের কর্মসংস্থান হারানোর রেকর্ড রয়েছে। ১৯৯৭ সালের এশীয় সংকটের পেছনে আইএমএফকেও অনেকাংশে দায়ী করা হয়। সে সময় আইএমএফের চাপে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো কঠোর অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণে বাধ্য হয়। আইএমএফের চাপের মুখে বাজেট ঘাটতি পূরণে সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি বিনিময় হারকে আরো শক্তিশালী করে দেশগুলো। এসব নীতির ফলে শ্লথ হয়ে পড়ে দেশগুলোর অর্থনীতি, যা রূপ নেয় ভয়াবহ মন্দায়। কর্মসংস্থান হারায় অসংখ্য মানুষ। কিন্তু এর পরও আইএমএফ নিজ অবস্থান থেকে সরে আসেনি। 

আইএমএফের আচরণে পরিবর্তনের আরেকটি উদাহরণ হতে পারে আর্জেন্টিনা। ২০০১ সালে দেশটিকে কৃচ্ছ্রসাধনে বাধ্য করে আইএমএফ। ফলে জনসেবামূলক খাতে সরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পায় ব্যাপক হারে, যার ধারাবাহিকতায় দেশটির অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দুই বছর আগে আরেকটি বড় অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। আইএমএফের কাছ থেকে হাজার ৭০০ কোটি ডলারের ঋণ নেয় দেশটি। ঋণের শর্ত পূরণ করতে দেশটির প্রেসিডেন্ট মরিসিও ম্যাক্রি কৃচ্ছ সাধন করতে গিয়ে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে দেন। ফলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ইলেকট্রিসিটি বিল আকস্মিকভাবেই ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয় বৃদ্ধির বোঝা চাপিয়ে দেয় ভোক্তাদের ওপর। এমন কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির মাত্রা হয়ে দাঁড়ায় লাগামছাড়া। দেখা দেয় তারল্য সংকট। ফলে মরিসিও ম্যাক্রি দেশটির অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা কখনই পূরণ হয়নি। এর ফলে গত বছর ভোটে হেরে যান মরিসিও ম্যাক্রি। অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রসাধন থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন পেরনপন্থী আলবার্তো ফার্নান্ডেজ।  

বিপাকে পড়ে গেলেও আইএমএফের ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হয়েছে দেশটিকে। পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি ঋণের হাজার ৪০০ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে আর্জেন্টিনা। ঋণের মেয়াদ পূর্তির কথা রয়েছে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে। বর্তমানে ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করছে দেশটি। কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি থেকে বেরিয়ে এলেও বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বক্তব্য দিয়েছে আইএমএফ। 

আইএমএফের নীতিগত পরিবর্তনের পেছনে কৃতিত্ব দেয়া হচ্ছে ক্রিস্টেলিনা জর্জিয়েভা গীতা গোপীনাথকে। মহামারী পরিস্থিতিতে সরকারি জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের সমর্থনে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন দুজনেই। আইএমএফের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইদানীং যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে কৃতিত্ব দেয়া হচ্ছে দুই নারীকেই। তবে পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদি না সাময়িক, তা সময়ই বলে দেবে। 

বুলগেরীয় অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টেলিনা জর্জিয়েভা আইএমএফের এমডি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এর আগে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এছাড়া জাঁ ক্লঁদ জাঙ্কারের অধীনে ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

প্রকৃতপক্ষে আগের আইএমএফ প্রধানদের তুলনায় জর্জিয়েভার প্রোফাইল অনেক বেশি মানবিক। ইউরোপীয় কমিশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, মানবিক সাহায্য সংকট মোকাবেলা বিষয়ক কমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সহায়তা বাজেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তার হাত ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়ে ওঠে দুর্যোগ সহনশীলতা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার চ্যাম্পিয়ন। মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সরকারিভাবে নাগরিক সুরক্ষা কার্যক্রমের পক্ষে শুরু থেকেই শক্ত অবস্থান নিয়ে চলেছেন তিনি। বিশ্বব্যাংকে থাকাকালে সংস্থাটির মধ্যকার অনেক সংস্কারেও সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন জর্জিয়েভা। 

অন্যদিকে কেরালার কন্নুরের একটি পরিবার থেকে উঠে আসা গীতা গোপীনাথের জন্ম কলকাতায়। তিনি আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৮ সালে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবারো স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। ডক্টরেট করেছেন নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। 

আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদের দায়িত্ব গ্রহণের আগে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব বোস্টন, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে কাজ করেছেন গীতা গোপীনাথ। এছাড়া ভারতের কেরালা রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউয়ের সহসম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে তিনি হ্যান্ডবুক অব ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের সহসম্পাদক রিভিউ অব ইকোনমিক স্টাডিজের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন