আন্তর্জাতিক টেনিসে একটি বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। কোটি সমর্থকের প্রিয় মুখ মারিয়া শারাপোভাকে কোর্টে রর্যাকেট নিয়ে আর ছুটতে দেখা যাবে না। খেলোয়াড় শারাপোভাকে এখন খুঁজতে হবে ফাইল ছবিতে! ইনজুরির কাছে হার মেনে ৩২ বছর বয়সে টেনিসকে বিদায় বললেন রুশ সুপারস্টার। পাঁচটি গ্র্যান্ড স্লাম বিজয়ী এ খেলোয়াড় রূপে ও গুণে অনন্যা। এ গুণ আর রূপ তাকে এনে দিয়েছে কোটি কোটি ডলারও। তবে কোর্টের চেয়েও বাইরের ভুবন থেকে বেশি আয় করেছেন তিনি। তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রীকে নিজেদের পণ্যের প্রচার ও প্রসারের কাজে লাগিয়েছে বিশ্বখ্যাত বহু ব্র্যান্ড। তাতে শারাপোভার ঘরে এসেছে কোটি কোটি ডলার।
শারাপোভার সাফল্যকে নানা উপায়ে পরিমাপ করতে পারেন: পাঁচটি গ্র্যান্ড
স্লাম শিরোপা, ৩৬টি ক্যারিয়ার একক
শিরোপা, বিশ্বের সাবেক এক
নম্বর খেলোয়াড়। কিন্তু ওইসব অবিশ্বাস্য সাফল্য কিছুতেই তার সমৃদ্ধ ব্যাংক হিসাবের
সাফল্যের সঙ্গে পেরে উঠবে না!
নারী ও পুরুষ মিলিয়ে টেনিসের অন্যতম শীর্ষ ধনী অ্যাথলিট হিসেবে অবসর নিলেন
শারাপোভা। টেনিসে মাত্র পাঁচজন পুরুষ খেলোয়াড় তার চেয়ে বেশি আয় করেছেন—নোভাক জোকোভিচ, রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, অ্যান্ডি মারে ও পিট
সাম্প্রাস। তার চেয়ে বেশি আয়কারী একমাত্র নারী সেরেনা উইলিয়ামস।
ডোপিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে শারাপোভার আলো ঝলমলে ক্যারিয়ারের পতন ঘটে
২০১৬ সালে। ফেরার পর কোর্টে ও কোর্টের বাইরে জ্যোতি হারাতে থাকেন। সাবেক এক নম্বর
খেলোয়াড়ের র্যাংকিং নেমে যায় ৩৭৩-এ!
সঙ্গে যোগ
হয় ধারাবাহিক ইনজুরি। কোর্টে ফ্লপ করায় আয়ও কমতে থাকে। কিন্তু শিরোপা কিংবা অর্থ
উপার্জনে আগেই তিনি গ্রেটদের কাতারে নাম লিখিয়ে নেন। টানা ১১টি বছর আমেরিকান
বিজনেস সাময়িকী ফোর্বসের সমীক্ষায় শীর্ষ ধনী নারী অ্যাথলিটের সম্মান পেয়েছেন।
গত চারটি বছর বিশাল অংকের আয় থেকে বঞ্চিত হন শারাপোভা। এর পরও
ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে ৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলার
(প্রায় ২
হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা) আয় করেছেন রুশ ললনা, যা আসে প্রাইজমানি, এনডোর্সমেন্ট ও
প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে। কোর্ট থেকে আয় করেন ৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। নারী টেনিস
তারকাদের মধ্যে আয়ে দুই নম্বরে থেকে অবসর নিলেন তিনি। ৩৫ কোটি ডলার আয় করে
শীর্ষস্থানটি ধরে রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেরেনা উইলিয়ামস। ২৩ বারের গ্র্যান্ড
স্লাম চ্যাম্পিয়ন সেরেনা অবশ্য ৩৮ বছর বয়সে এখনো খেলে যাচ্ছেন। তাই আয়ে সহসাই তাকে
কেউ সিংহাসনচ্যুত করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।
রাশিয়া থেকে শৈশবে মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো শারাপোভার বসবাস ফ্লোরিডায়। রুশ পতাকায় টেনিস খেললেও থাকেন আটলান্টিকের ওপারেই। ২০০১ সালে পেশাদার টেনিসে যাত্রা। তবে টেনিসে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ২০০৪ সালের উইম্বলডন ফাইনালে সেরেনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সে শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে। ওই জয়ের আগে তার স্পন্সর ছিল শুধুই নাইকি ও প্রিন্স। কিন্তু এরপর বদলে গেল চিত্র। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার লাবণ্যময়ী শারাপোভা ছিলেন নামি ব্র্যান্ডগুলোর কাছে এক স্বপ্ন। শিগগিরই বাজারের কর্তৃত্ব নিতে থাকে তার এজেন্ট আইএমজি। ট্যাগ হিউয়ার, ক্যানন, মটোরোলা, কোলগেট-পালমোলিভসহ অনেক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে থাকেন তিনি। তার নাইকি চুক্তির আর্থিক মূল্যও বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল। এতে তার বার্ষিক আয় ৩০ লাখ ডলার থেকে বেড়ে হয়ে গেল ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার! এতে অচিরেই তিনি হয়ে গেলেন এ ভুবনের শীর্ষ ধনী নারী অ্যাথলিট।
কোর্টের পাশাপাশি বাণিজ্যের জগতে তার জয়যাত্রা তখন চলছেই। এরপর তার
নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ল্যান্ড রোভার,
পেপসিকো ও
সনির মতো শীর্ষ ব্র্যান্ড। তার নামে টেনিসের নানা পণ্য বাজারে নিয়ে এল নাইকি। তার
নামের ব্যালে ফ্লাট সু তো সর্বাধিক বিক্রির রেকর্ডই গড়ে বসে।
এভাবেই ট্যুর টেনিসের সবচেয়ে বড় আকর্ষণে পরিণত হন শারাপোভা এবং
প্রদর্শনী ম্যাচের জন্য ৫ লাখ ডলার ফি নেয়া শুরু করেন। টেনিসের খ্যাতি কাজে লাগিয়ে
২০১২ সালে ‘সুগারপোভা’ নামে নিজের ক্যান্ডি লাইন ব্যবসা শুরু
করেন তিনি এবং এখন তা দারুণ প্রতিষ্ঠিত। পরে এর সঙ্গে কাপড় ও অ্যাকসেসরিজ যুক্ত
করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিশাল অনুসারী গড়ে ওঠে শারাপোভার, যা তার আয়ের আরেকটি
বড় উৎস। ২০১৬ সালে নিষিদ্ধ হওয়ার আগের বছর তিনি ফেসবুক থেকে আয় করেন ৩ কোটি
ডলার।
নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাকে ছেড়ে যায় ট্যাগ হিউয়ার, কোর্টের বাইরের আয়ও
কমতে থাকে। যদিও নাইকি, এভিয়ান ও পোরশের মতো
ব্র্যান্ড তাকে ছেড়ে যায়নি। ২০১৭ সালে খেলায় ফিরলেও কাঁধের ইনজুরি তাকে
মারাত্মকভাবে ভোগাতে থাকে। গত বছর মাত্র ১৫ ম্যাচ খেলেছেন, তখন তিনি র্যাংকিংয়ের ৩৭৩-এ নেমে যান। তার সর্বশেষ টুর্নামেন্ট ছিল গত মাসে অনুষ্ঠিত
অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে, যেখানে তিনি প্রথম
রাউন্ডেই হেরে যান। তখনই গুঞ্জন ওঠে,
হয়তো
আগামী বছর মেলবোর্ন পার্কে তাকে দেখা যাবে না। সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো।
পাঁচটি গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা ও সব মিলিয়ে ৩৬টি একক শিরোপা সঙ্গী করে
অবসরে গেলেন শারাপোভা। ইতিহাসে মাত্র ১০ নারী চার ধরনের গ্র্যান্ড স্লামই জিতেছেন, শারাপোভা তাদের
অন্যতম। পাঁচটি ভিন্ন সময়ে র্যাংকিংয়ের শীর্ষে ওঠার গৌরব দেখিয়েছেন।
শারপোভার ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার প্রাইজমানি নারী টেনিস তারকাদের মধ্যে
তৃতীয় অবস্থান। তার চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন সেরেনা (৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার)
ও তার বড়
বোন ভেনাস উইলিয়ামস (৪ কোটি ১০ লাখ ডলার)।
বিদায়ের ঘোষণায় শারাপোভার মন ছুঁয়ে নেয়া কথা, ‘টেনিসই আমাকে বিশ্ব
দেখিয়েছে এবং আজ আমি যা, তা টেনিসই করে
দিয়েছে।’
কোর্টের প্রাইজমানি থেমে গেলেও আয় কমবে না শারাপোভার।
সুগারপোভা দারুণ সফলতা পাচ্ছে। ২০১৯ সালে ২ কোটি ডলার রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন
করেছে কোম্পানিটি। আজ এবিসির ‘শার্ক
ট্যাংক’ অনুষ্ঠানে নিজের ‘উদ্যোক্তা’ পরিচয় নিয়ে কথা বলবেন টেনিসের এ সুপারস্টার। ফোর্বস