অন্য ভাষা শেখা দরকার, তবে মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে নয় : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা বর্তমানে গ্লোবাল ভিলেজে বসবাস করছি। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গেলে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাই অন্য ভাষা শেখারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে নয়। মহান ভাষা দিবস উপলক্ষে গতকাল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত এক সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন অনেকের মধ্যে ভাষা নিয়ে হীনম্মন্যতা কাজ করে। আমরা দেখি অনেকেই মনে করেন, ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মিডিয়ামে না পড়ালে ভালো চাকরি পাবে না, সমাজে চলতে পারবে না। তারা একধরনের মানসিক দীনতায় ভোগেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

অনেকের ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলার চেষ্টায় হতাশা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, অনেক ছেলেমেয়ে বাংলা ভাষা বা নিজেদের এলাকার ভাষায় কথা ভুলে গিয়ে কেমন যেন একটা ইংরেজি একসেন্টে বাংলা বলার চেষ্টা করে। মানে হলো, বাংলা বলতে ওদের খুব কষ্ট হচ্ছে। তাদের উচ্চারণে যদি কোনো সমস্যা হয়, তাতে দোষ দেয়ার কিছুই নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে থেকে যাদের ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলতে হয়, তাদের প্রতি করুণা ছাড়া কিছুই নেই।

তিনি বলেন, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর বাবা-মা, ভাইকে হারিয়ে রিফিউজি হিসেবে বিদেশে ছিলাম। তাই শুরু থেকে সন্তানদের বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। আমাদের সন্তানকে পড়াতে হয়েছে বিদেশী স্কুলে। সেখানেও আমরা চেষ্টা করেছিলাম তাদের বাংলা ভাষা শেখাতে। আমরা ঘরে সবসময়ই বাংলা ভাষা বলতাম। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে।

নিজের ভাষা চর্চা সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, সভা-সমাবেশে একটু ভালোভাবে বাংলা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘরে যখন বলি তখন আমরা গোপালগঞ্জের ও ঢাকার ভাষা মিলিয়েই বলি। কারণ ছোটবেলায় চলে এসেছি ঢাকা শহরে, তাই ঢাকার ভাষার একটা প্রভাব। আবার টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে জন্ম নিয়েছি, সেখানকার ভাষারও একটা প্রভাব। সব মিলিয়ে আমরা বলি, তাতে আমাদের কোনো লজ্জা নেই। আপনারা দেখেছেন, জাতির পিতা তার ভাষণে গোপালগঞ্জের শব্দগুলো বলে গেছেন অকাতরে, যা মানুষের ভেতরে একটা আবেদন সৃষ্টি করেছে। তিনি খুব দ্রুত মানুষের হূদয়ে ও কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষা মানুষের মনের ভাব, চাহিদাসহ সবকিছু ব্যক্ত করারই একটা মাধ্যম। ভাষাটা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের মূল শক্তি। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে যোগাযোগ তা ভাষার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। কাজেই ভাষার গুরুত্ব রয়েছে, বিশেষ করে মাতৃভাষার। একটি দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি এই ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাতৃভাষা কেড়ে নেয়ার চক্রান্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত একটি শিক্ষা সম্মেলনের মাধ্যমে। সেখানে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠার দিক থেকে এখানকার লোকই ছিল বেশি। সংখ্যায় আমরা ৫৬ ভাগ, কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা বাংলার অধিকার কেড়ে বিজাতীয় উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন থেকেই আমাদের ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ এফএইচ হলে একটি সভা হয় ছাত্রদের। সেই সভার উদ্যোক্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস আরো কয়েকটি ছাত্রসংগঠন নিয়ে বৈঠক হয়। তার প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত হয়, ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে পালন হবে। সেই দিন থেকেই আমাদের আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, তারপর তাকে (বঙ্গবন্ধু) বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হয়। যখনই তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন স্থানে সফর করেছিলেন। মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন। এরপর ১৯৪৯ সালে তাকে যখন গ্রেফতার করা হলো, আর মুক্তি দেয়া হয়নি। ১৯৫২ সালে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু বন্দি অবস্থায়ও যখন চিকিত্সার জন্য তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হতো, সেখানে তিনি আমাদের ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতেন। আবার এ কারণে তাকে কারাগারে ফেরত পাঠানো হতো। এভাবে এ আন্দোলনটা গড়ে ওঠে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা ভাষা সম্পর্কে সচেতন ও আন্তরিক ছিলেন। তিনি বলতেন, মাতৃভাষার অপমান সহ্য করা যায় না।

যখন ভাষার ওপর আঘাত এল তখন থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেনআর পাকিস্তানিদের সঙ্গে না, আমাদের আলাদা থাকতে হবে। আলাদা রাষ্ট্র করতে হবে। সেই কথাটা মনে রেখেছিলেন তিনি, কখনো মুখে প্রকাশ করে বলেননি। প্রতিটি পদক্ষেপ, আন্দোলন সংগ্রামের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি একটি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, জাতির পিতার বাংলা ভাষা নিয়ে যে প্রীতি সেটা আমরা পাই তার লেখায়। কয়েকদিন আগে তার একটা বই বেরিয়েছে, যেটা ১৯৫৪ সালে লেখা। ১৯৫২ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে একটি শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে চীন যান তিনি। ১৯৫৪ সালে তিনি যখন আবার কারাগারে যান, তখন তিনি চীনের ওপর নয়াচীন বইটা লিখেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, পিকিংয়ে যখন তাকে বক্তৃতা করতে দেয়া হয়েছিল, তখন তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সাল থেকেই শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তিনিই প্রথম বাংলায় বক্তব্য রাখেন। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পরে আমি যতবার জাতিসংঘে গিয়েছি ততবারই  জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছি।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গঠনের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি আমরা পেলাম, তখন এই ইনস্টিটিউট গঠনের সিদ্ধান্ত নিই। সেটা আমাদের সরকারের একেবারে শেষ সময়ে ছিল। তত্কালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে দিয়ে আমরা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম। নির্মাণকাজও শুরু করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা আর কোনো কাজই করেনি। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমরা নির্মাণকাজ পুনরায় চালু করি। একদিকে ভালোই হয়েছে তারা এটা শেষ করে যায়নি। কারণ এটা আমি শুরু করেছিলাম, আমি শেষ করে সেটার উদ্বোধন করি। সেজন্য আমি বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ তিনি এর নির্মাণকাজ করেননি, বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন