এশিয়া-প্যাসিফিকে দ্বিতীয় নিবাস গড়ছেন বাংলাদেশীরা

মনজুরুল ইসলাম

উন্নত জীবনের খোঁজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে অভিবাসী হচ্ছেন বাংলাদেশীরা। অর্থ সম্পদ পাচারের দুরভিসন্ধিসহ নানা কারণে আইনের নাগাল এড়ানোর তাগিদ থেকেও ঘটছে অনেক স্থায়ী অভিবাসনের ঘটনা। শরণার্থী হিসেবেও যাচ্ছেন অনেকে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশীদের স্থায়ী অভিবাসন নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক  শেষ পর্ব

 দেশে অর্জিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় নিবাস গড়ছেন বহু বাংলাদেশী। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিনিয়োগ করছেন তারা। তালিকায় রাজনীতিবিদ, ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্সের মালিক, মাঝারি ব্যবসায়ী ঠিকাদার যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারাও।

গত বছর ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িতদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে মালয়েশিয়ার আমপাং তেয়ারাকুন্ডতে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ফ্ল্যাট থাকার তথ্য পায় দুদক। মালয়েশিয়া সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পের আওতায় ওই ফ্ল্যাট কেনেন সম্রাট। শুধু সম্রাট নন, সেকেন্ড হোম প্রকল্পের সুযোগ নিয়ে মালয়েশিয়ায় মোটা অংক বিনিয়োগে বাড়ি কিনেছেন অন্তত ২৫০ বাংলাদেশী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেহেতু ধরনের অর্থ স্থানান্তরের কোনো তথ্য নেই, সেহেতু মালয়েশিয়ায় বাড়ি কিনতে পাঠানো পুরো অর্থই গেছে অবৈধ পন্থায়। এমনকি পাচারের টাকায় অনেক বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় দাতো (মালয়েশিয়ার জাতিগত পদবি) উপাধিও পেয়েছেন।

বাংলাদেশীদের অঢেল অর্থ-সম্পদের সন্ধান মিলেছে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককেও। সম্প্রতি বহিষ্কৃত যুবলীগের আরেক নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার অনেক অর্থ-সম্পদ রয়েছে ব্যাংককে। সেখানে হোটেল, রেস্টুরেন্ট আবাসন ব্যবসায় বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তিনি। খালেদ একা নন, তার মতো আরো অনেকেই দেশটিতে বিনিয়োগ করেছেন। রাজধানী ব্যাংকক, পাতায়া, ফুকেটসহ বেশ কয়েকটি পর্যটন শহরে আবাসন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট শপিং মল গড়ে উঠেছে বাংলাদেশীদের টাকায়। বহু বাংলাদেশী কোটি টাকা খরচ করে থাইল্যান্ডে বসবাসের জন্য স্থায়ী ভিসা সুবিধাও নিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের থাইল্যান্ডে একাধিক হোটেল রিসোর্ট ব্যবসা রয়েছে। কথিত আছে, দেশটির বিমানবন্দরে অবতরণ করলে বিশেষ সুবিধা পান তারা। 

বিদেশীদের জন্য থাইল্যান্ডের রয়েছে এলিট রেসিডেন্সি অফার। অফার অনুযায়ী ওই দেশে বসবাস করতে প্রতি বছর কমপক্ষে হাজার ডলার খরচ করতে হবে। সেখানে বসবাসের জন্য সাতটি প্যাকেজ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্যাকেজটি হলো ২০ বছরের জন্য বসবাসের অনুমতি। এক্ষেত্রে ৬০ হাজার ডলার খরচ করতে হবে। পাঁচ বছর বসবাসের অনুমতির জন্য এলিট ইজি অ্যাকসেস প্যাকেজ অনুযায়ী প্রতি বছর খরচ করতে হবে ১৫ হাজার ২৫৩ ডলার বা ১২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। স্ত্রী কিংবা স্বামীকে নিয়ে থাকতে চাইলে পাঁচ বছরের জন্য এককালীন ২৪ হাজার ৪০৫ ডলার ছাড়াও জনপ্রতি আরো হাজার ১৫২ ডলার করে পরবর্তী সময়ে পরিশোধ করতে হয়। কর্মসূচির আওতায়ও বিত্তশালী অনেক বাংলাদেশী থাইল্যান্ডে বসবাসের সুযোগ নিচ্ছেন।

বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকের অফিস রয়েছে সিঙ্গাপুরে। সেখানে ব্যাংকের আন-অফিশিয়াল বোর্ড মিটিংও করেন তারা। দেশটিতে অফশোর আর্থিক সেবার বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে। একই সঙ্গে হয়ে উঠেছে মুদ্রা পাচার কালো টাকার নিরাপদ গন্তব্যস্থলও। সুযোগ নিচ্ছেন বাংলাদেশীরা। সিঙ্গাপুরে বেশকিছু ক্যাসিনোর মালিকানায় রয়েছেন বাংলাদেশীরা, যেগুলো কালো টাকার অন্যতম গন্তব্য। বাংলাদেশ থেকে গত পাঁচ বছরে যেসব প্রভাবশালী অর্থ পাচার করে সিঙ্গাপুরে ক্যাসিনো ব্যবসায় লগ্নি করেছেন জুয়া খেলেছেন তাদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে গত বছর সিঙ্গাপুর সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক।

বৈশ্বিক আর্থিক গোপনীয়তার সূচকে সিঙ্গাপুরের অবস্থান পঞ্চম।  আর্থিক গোপনীয়তার সুযোগ নিয়ে দেশটিতে অর্থ পাচার করছেন অনেকেই।  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে। উচ্চমূল্যে আমদানি দেখিয়ে দেশটিতে অর্থ পাচার করছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি আমদানি-রফতানির অন্যতম রুট হওয়ায় ব্যবসায়ীদের নিত্য গন্তব্য হয়ে উঠেছে সিঙ্গাপুর। গার্মেন্ট বা টেক্সটাইলের মেশিনারিজ আমদানির জন্যও দেশটিতে যেতে হয় ব্যবসায়ীদের। সুযোগ কাজে লাগিয়েও অনেকে দেশটিতে অর্থ স্থানান্তর করেন।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বিনিয়োগ কোটায় স্থায়ী আবাস গড়ছেন বাংলাদেশীরা। বিনিয়োগকারীদের জন্য ২০১৯ সাল থেকে ১০ বছরের আবাসিক ভিসা চালু করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।   ভিসা পেতে কমপক্ষে কোটি দিরহাম বা ২৩ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে হবে দেশটিতে। এটি চালুর পর সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্যাংক পরিচালক দুবাইয়ে গোল্ড কার্ড রেসিডেন্সি ভিসা পেয়েছেন। 

আমিরাতের স্থায়ী ভিসা প্রসেসিং এজেন্ট হিসেবে সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া একটি প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগের পরিচালক প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, আমিরাত সরকারের ঘোষিত বিনিয়োগ ক্যাটাগরিতে স্থায়ী ভিসা পেতে অনেক বাংলাদেশী আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ভিসা পেতে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। আমরা বিষয়ে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।

বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থায়ী অভিবাসনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশীদের অন্যতম গন্তব্য অস্ট্রেলিয়া। দেশটির একটি বিশেষ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে কানাডার বেগম পাড়ার মতো আরেকটি পাড়া। সেখানে একাধিক এমপির বাড়ি রয়েছে, যেখানে তাদের সন্তানরা থাকছেন।

২০১২ সালে চালু হওয়া অস্ট্রেলিয়ার নতুন অভিবাসন আইন অনুযায়ী, দেশটির নাগরিকত্ব লাভের জন্য বিবেচিত হতে হলে একজন ব্যক্তিকে কমপক্ষে দশমিক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। বিনিয়োগের প্রায় তিন মাস পর বিনিয়োগকারী হিসেবে ইনভেস্টর ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন। যাদের এই ভিসা রয়েছে তারা চার বছর পর অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা আবজাল হোসেনের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অন্তত হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে দেশে-বিদেশে। অস্ট্রেলিয়ায়ও রয়েছে তার বাড়ি ব্যবসা। দুদকের অনুসন্ধানে আবজালের মতো আরো কিছু দুর্নীতিবাজ বাংলাদেশীর অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে, যারা অস্ট্রেলিয়ায় রিয়েল এস্টেট এবং অন্যান্য ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। এই দুর্নীতিবাজদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে অস্ট্রেলিয়ার সহযোগিতাও চেয়েছে দুদক।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার। সেখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন কয়েক লাখ বাংলাদেশী। অধিকাংশ শ্রমিকই দেশটিতে মানবেতর জীবন যাপন করলেও সেকেন্ড হোম প্রকল্পে অংশ নেয়া বাংলাদেশীরা আছেন বেশ আরামে। মূলত সহজে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং উন্নত জীবনযাপনের মতো সুযোগ থাকায় মোটা অংকের বিনিয়োগ করে দেশটিতে স্থায়ী নিবাস গড়ছেন বাংলাদেশীরা।

জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএম২এইচ) প্রকল্পে অংশ নেয়া সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এমএম২এইচ প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন মোট হাজার ১৩৫ জন বাংলাদেশী। এরই মধ্যে মালয়েশিয়ায় বাড়ি কিনেছেন ২৫০ জন বাংলাদেশী। মালয়েশিয়ায় বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের পরই আছেন বাংলাদেশীরা।

মালয়েশিয়ায় এমএম২এইচ প্রোগ্রামে ১০ বছরের নন-মালয়েশিয়ান ভিসার জন্য আবেদন করতে বাংলাদেশী ৫০ বছরের অনূর্ধ্বদের অ্যাকাউন্টে জমা থাকতে হয় লাখ রিঙ্গিত বা কোটি লাখ টাকা এবং মালয়েশিয়ার ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করতে হয় ৬৫ লাখ টাকা। ৫০-ঊর্ধ্বদের জন্য অ্যাকাউন্টে থাকতে হবে সাড়ে লাখ রিঙ্গিত বা ৭৫ লাখ টাকা। মালয়েশিয়ায় ফিক্সড ডিপোজিট করতে হবে ৩২ লাখ টাকা। তবে উভয় ক্ষেত্রে মাসিক আয় হতে হবে কমপক্ষে লাখ ১২ হাজার টাকা।

বিদেশে বাংলাদেশীদের দ্বিতীয় নিবাস গড়া সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক . ইমতিয়াজ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশীরা দ্বিতীয় কোনো দেশে গিয়ে বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। অনেকে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করছেন। আবার অনেকে দেশে ব্যবসা করে অর্থ নিয়ে বিদেশে বসবাস করছেন। এটা যদি ট্যাক্স দিয়ে বৈধভাবে হতো তাহলে আপত্তি থাকত না। কিন্তু অবৈধভাবে অর্থ নিয়ে অন্য দেশে বিনিয়োগ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ওই সব দেশের সঙ্গে সরকারের আলোচনার প্রয়োজন আছে যে কেন তারা এটির বৈধতা দিচ্ছেন। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ, যারা সবসময় ট্রান্সপারেন্সির কথা বলে, তারা কেন জেনেবুঝে অবৈধ অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দিচ্ছেসে বিষয়ে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

প্রলোভন ও পলায়নে সেরা আকর্ষণ এখনো যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য (পর্ব২)
কানাডায় স্থায়ী অভিবাসন : কেউ ভাগ্যান্বেষণে, কেউ যাচ্ছেন লুট করে (পর্ব ১)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন