সিল্করুট

বাংলার তামাকনামা

সুমাইয়া মুবিন

অ্যাঞ্জেলো বিয়াসিওলির চিত্রকর্মে বাঙালির তামাকসেবন ছবি: ওয়েলকাম কালেকশন

পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে নানা ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ বাংলাদেশে অতি প্রাচীনকাল থেকেই এসেছে। বাংলার আদি জনগোষ্ঠী এ বহিরাগত ভাষা-সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে নিজ উদারতা এবং গ্রহণ-বর্জনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায়। বাংলার এ অনন্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, স্বভাবজাত উদারতা এবং নতুনত্বের প্রতি আকর্ষণ থেকেই বাংলার মানুষ তামাক গ্রহণ করেছিল নাকি তামাক এ অঞ্চলেই উৎপাদিত হতো সেই প্রশ্নোত্তরের জটিল প্রক্রিয়া এড়িয়ে ইতিহাসের ঠিকুজিনামায় তামাক ব্যবহারের তথ্যাদি পাঠকের দরবারে উপস্থাপনের অভিপ্রয়াসে আমার আজকের এ রচনা।

ধনসম্পদে পরিপূর্ণ সোনার বাংলায় ঠিক কবে থেকে তামাকের চাষ শুরু হয়েছিল এবং নেশাদ্রব্য হিসেবে মানুষ তামাকের ব্যবহার শুরু করেছিল সে সম্পর্কিত তথ্য বাংলার ইতিহাসের আদি ও মধ্যযুগের আকরসূত্রাদিতে নেই বললেই চলে। তাই প্রচলিত উৎসাদিতে তামাকের পণ্যায়ন, বিস্তার, ব্যবহার, অর্থনৈতিক বিপণন সম্পর্কিত কিছু তথ্য পাঠকের সামনে হাজির করা যেতে পারে। ষোড়শ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের কালে বাংলায় আগত পর্যটকদের বিবরণ, দেশজ সূত্র তথা বাংলা সাহিত্যে বিক্ষিপ্ত উল্লেখের আশ্রয়ের বিকল্প নেই। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়, মোহাম্মদ আব্দুর রহিম, দীনেশচন্দ্র সেন, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় উপস্থাপিত এ বিষয়ক তথ্য হাজির করেই আলোচনাটি চালিয়ে নেয়া হবে। উল্লেখ্য, সপ্তদশ শতকের মোগল বাংলার রোজনামচাকার মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়েবি গ্রন্থেও একটি তথ্য আমাদের আলোচনার রসদ জোগাবে।

মানবসভ্যতায় তামাকের ব্যবহার প্রাচীন হলেও ঠিক কত শতাব্দী থেকে অর্থকরী ফসল হিসেবে তামাকের ব্যবহার শুরু হয় সে সম্পর্কিত লিখিত কোনো ইতিহাস জানা যায় না এবং যা পাওয়া যায় তাও বেশ দুর্বোধ্য এবং প্রশ্নবিদ্ধ। কম্পটন ম্যাকেঞ্জি তার Sublime Tobacco বইটিতে বলেছেন ১৪৯২ সালে কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করেন তখনই তিনি প্রথম ফসল হিসেবে তামাকের চাষাবাদ সম্পর্কিত তথ্য আবিষ্কার করেন। কিন্তু জে বি কিল্লব্রিউ এবং এইচ ম্যারিক্ক তাদের Tobacco Leaf, its Culture and Cure, Marketing and Manufacture পুস্তকে উল্লেখ করেন চায়নিজরা আমেরিকানদের আগে থেকেই তামাক চাষাবাদ ও সেবন করত। ষোড়শ শতকের আগ পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলে তামাকের ব্যবহার নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। পর্তুগিজ লেখক দুয়ার্তো বারবোসার লেখনী থেকে জানা যায়, ষোড়শ শতকে পর্তুগিজদের মাধ্যমে উপমহাদেশে প্রথম তামাকের প্রবর্তন শুরু হয় এবং এখন অব্দি এ উপমহাদেশ তামাকজাত পণ্য উৎপাদন বিপণনের বড় ক্ষেত্র।

ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ আব্দুর রহিম বাংলার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস বর্ণনায় তামাকের আদি ইতিহাস সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে:

স্পেনীয়রা ইউরোপে তামাক আমদানি করে এবং ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডেও তামাকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। পর্তুগিজরা তামাক সেবন প্রক্রিয়া স্পেনীয়দের কাছ থেকেই শিখে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা এটা প্রাচ্য দেশে নিয়ে আসে। পর্তুগিজদের তামাক সেবন প্রক্রিয়া দাক্ষিণাত্যে বেশ বড় বাজার দখল করে নেয়। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সপ্তদশ শতকের দিকে সম্রাট আকবরের দরবারে তামাক সেবন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে এটি মোগল সাম্রাজ্যে বিস্তার লাভ করে। ষোড়শ শতকের দ্বিতীয় দশকে পর্তুগিজদের সাথে বাংলার বিভিন্ন বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই পর্তুগিজদের মাধ্যমে এই বাংলায় তামাক সেবন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এটা ধীরে ধীরে সামাজিক জীবনের একটি অপরিহার্য অভ্যাসে পরিণত হয়। কালক্রমে বাংলার সামাজিক-পারিবারিক পরিসরে ধূমপান একটি অভ্যাসের বিষয় হয়ে ওঠে।

দীনেশচন্দ্র সেনের বাংলা সাহিত্যের পরিচয় গ্রন্থে সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে নানা রচনায় তামাকের ব্যবহার তুলে ধরা হয়েছে। প্রসঙ্গত বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলের কথা উল্লেখ করা যায়।

মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়েবি বইটিতে বিভিন্ন সময়ে সেই সময়ের ধূমপান সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনা উঠে এসেছে। অষ্টাদশ শতকের ফারসি ভাষায় সমসাময়িক ঘটনাপঞ্জির লেখক গোলাম হোসেন তাবাতাবায়ীর লেখনীতে বাংলার নবাবি দরবারের প্রথা বর্ণনায় তামাক সেবনের তথ্য পাওয়া যায়। সিয়ার-উল-মোতাখখরীন গ্রন্থে গোলাম হোসেন উল্লেখ করেন যে,

নবাব আলিবর্দি খান নিজে ধূমপান করতেন না কিন্তু তার দরবারে বিশিষ্ট মেহমানদের জন্য ধূমপান ও তামাক পানের ব্যবস্থা ছিল। সাহিত্যসংক্রান্ত আলোচনায় বিদ্বান ব্যক্তিদের সেখানে হুক্কা দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো বলেও জানা যায়। (পৃষ্ঠা ৬১০)

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের Begums of Bengal গ্রন্থ থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকে বাংলার বহু মহিলা তামাক সেবনে অভ্যস্ত ছিলেন। মিরজাফরের স্ত্রী মুন্নী বেগম স্বয়ং বৃদ্ধকালে হুক্কা পান করতেন বলে জানা যায়।

ধীরে ধীরে তামাক ব্যবহার বাংলা সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বাংলা তামাক উৎপাদনকারী এবং সেবনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। বাংলায় তামাক বিভিন্ন রূপে ব্যবহৃত হতো। যেমন ধূমপান করা তামাক এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক। প্রধান প্রধান তামাক ধূমপান পণ্য সিগারেট, হুক্কা, বিড়ি, পাইপ, সিসা প্রভৃতি। সাধারণত তামাক পাতা সিদ্ধ, ভাঙ্গা এবং ফ্লেক করে মসলা মিষ্টি এবং বিভিন্ন মিশ্রণ সহকারে পানের সাথে খাওয়া হতো। ধোঁয়াবিহীন তামাক, জর্দার সঙ্গে পান, জর্দা দিয়ে সুপারি, সাদা পাতার সঙ্গে পান, গুল ব্যবহারের প্রচলন ছিল। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার সাধারণত নিম্ন অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে জড়িত ছিল।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১. C. Mackenzie: Sublime tobacco, chatto and winds, London, 1957

২. এম এ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, বাংলা একাডেমি ঢাকা, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৮২

৩. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৩৫৯

৪. ওয়াকিল আহমদ, বাংলায় বিদেশি পর্যটক, গ্লোব লাইব্রেরি, ১৯৬৮

৫. J.B. Killebrew and H.Myrick: Tobacco leaf, its Culture and Cure, Marketing and Manufacture

৬. বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল

৭. ষষ্ঠীবর মনসামঙ্গল

৮. ডি সি সেন, বাংলা সাহিত্যের পরিচয়

সুমাইয়া মুবিন: শিক্ষক, ইতিহাস বিভাগ

মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ